ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের পাসওয়ার্ড ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ায় এনআইডি জালিয়াতি বাড়ছে
মাঠ পর্যায়ের অনেক নির্বাচন কর্মকর্তারা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করার জন্য ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে সফটওয়্যার ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকেন। ফলে, অপরাধীরা এনআইডি কার্ড জাল করার সুযোগ নিয়ে থাকে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, ডেটা এন্ট্রি অফিসারদের একটি অংশ অর্থের বিনিময়ে একটি চক্রকে কার্ড জালিয়াতি করতে সহায়তা করেন।
নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখার শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, শিগগিরই এনআইডি সেবা সম্পর্কিত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন অফিসগুলোতে অভিযান শুরু হবে।
উপজেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা জানান, ইসির প্রধান সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নামের একটি সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পাসওয়ার্ড পেয়ে থাকেন।
এনআইডি শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ কারণেই অসাধু ডেটা এন্ট্রি অফিসাররা জালিয়াতি করার সুযোগ পান।’
ভোটার নিবন্ধকরণ ও এনআইডি কার্ড সংশোধনের জন্য উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদেরও পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হয়।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, জালিয়াতি বন্ধের জন্য ইসি ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড চালুর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যদি কেউ সিস্টেমে প্রবেশ করে তবে, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ব্যক্তির ছবি তুলবে। কোনো ব্যক্তি সিস্টেমে কত সময় ব্যয় করছে তাতেও আমরা নজর রাখতে পারব।’
গত শনিবার, রাজধানীর সবুজবাগ ও গুলশান নির্বাচন অফিসের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শঙ্কর সূত্রধর (৩২) ও মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলামকে (২৮) জাল এনআইডি ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর নির্বাচন কমিশন থেকে তাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে দুজন ডেটা এন্ট্রি অফিসারকে গ্রেপ্তারের পর দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দুই কমিটিকেই মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু ও দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) জানিয়েছে, গত এক বছরে একটি চক্র জাল এনআইডি দিয়ে ব্যাংক ঋণ পেতে কমপক্ষে ৪০ জনকে সহায়তা করেছিল।
রোববার, মিরপুরে গ্রেপ্তার হওয়া এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই তথ্য জানা গেছে। গ্রেপ্তার হওয়া ওই পাঁচ জন হলেন মামুন (৪১), সুমন পারভেজ (৪০), মো. মজিদ (৪২), সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২), আনোয়ারুল ইসলাম (২৬)।
গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এই চক্রের আরও চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ নির্বাচন কমিশনের আরও কিছু কর্মী জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। এটি নিশ্চিত হতে আমাদের কিছুটা সময় প্রয়োজন।’
জালিয়াত চক্র যেভাবে কাজ করে
ডিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, ঋণখেলাপিদের নতুন করে ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দিতে জালিয়াতি প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ করে এই চক্র।
ডিজি (লালবাগ বিভাগ) এর জেলা প্রশাসক রাজিব আল মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ব্যাংক ঋণ পেতে গ্রাহকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) রিপোর্ট সন্তোষজনক না হলে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র অভিনব উপায়ে ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দিতে ইসি অফিসের কর্মকর্তাদের সাহায্য নিয়ে কাজ করে।
এরপর ডেটা এন্ট্রি কর্মকর্তাদের সহায়তায় দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া সুমন পারভেজ আগে একটি অডিট ফার্মে কাজ করতেন, যার কাজ ছিল ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত নির্দেশাবলী অনুযায়ী ঋণ প্রার্থীদের নথি যাচাই করা। তাই, কীভাবে এই নথিগুলো নকল করা যায় সে ব্যাপারে সুমন ভালোভাবেই জানেন।
গ্রেফতারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার সমন্বয়কারী ডিসি রাজিব আল মাসুদ জানান, ডাট্রা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছে ইসির সার্ভারের একসেস দেওয়া থাকে। এই সুযোগ নিয়ে প্রথমে তারা ঋণ পেতে আগ্রহীদের তথ্য দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করতো। তারপর ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নতুন একটি নামে ওই ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করতেন। পরদিন সার্ভারে নতুন তথ্য আপলোড দেওয়া হতো।
তিনি আরও বলেন, ‘সার্ভারে এ ধরনের ইনপুট সম্পর্কিত নোটিফিকেশন আসতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যেই দালালরা ব্যাংক ঋণের জন্য জাল এনআইডি ব্যবহার করে অন্যান্য নথি তৈরি করেন। এমনকি, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যখন এনআইডি যাচাই করেন তখনো জাল এনআইডিগুলো আসল হিসেবে দেখানো হয়।
Comments