শুধু বাঁশিবাদকই হতে চেয়েছিলাম: গাজী আবদুল হাকিম
দেশের প্রথিতযশা বাঁশিবাদক গাজী আবদুল হাকিম। দীর্ঘ ৫৫ বছর বাঁশি দিয়ে মন জয় করে চলেছেন দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষের। দেশ-বিদেশে প্রায় ২৫টির মতো বাঁশির অডিও অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে এই শিল্পীর। দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সংগীত জীবনের এই দীর্ঘ যাত্রার অর্জন, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলেছেন গুণী এই শিল্পী।
বাঁশি নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কতটা কাছাকাছি যেতে পেরেছেন?
কতটুকু যেতে পেরেছি এটা বলা খুব মুশকিল। এখনো জানার-শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার জন্মটাই হয়েছে বোধহয় বাঁশি বাজানোর জন্য। এই কথাটা সব জায়গায় বলি। কারণ সেই ছোট বয়সে আমার অন্য কিছু করার কথা মাথায় আসেনি। কেন শুধু বাঁশি বাজাবার কথাই আমার মাথায় আসলো। পরিবারের সবাই চেয়েছিলেন লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরি করব। কিন্তু, আমি অন্য কোনো কিছুই হতে চাইনি। শুধু বাঁশিবাদকই হতে চেয়েছিলাম। জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল, তা হলো— বাঁশি। অন্য কিছু মাথায় আসেনি।
বাঁশির প্রতি মুগ্ধতা কি পারিবারিক আবহ থেকে পাওয়া? বাঁশির হাতেখড়ি কার কাছে?
যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন থেকেই আমার আম্মা ঘুম পাড়াতেন ‘ওরে আমার গহীন গাঙের নাইয়া’ এই ধরনের গান শুনিয়ে। ছোটবেলা থেকেই হয়তো কানের মধ্যে সুর খেলা করতো। পাশের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। উনি গান করতেন, বাঁশি বাজাতেন। সেই ছোটবেলা থেকে উনার বাসায় সারাদিন থেকে চর্চা করতাম। কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেটা মুকুল বিশ্বাসের কাছে। তার গুরু ছিলেন দুলাল বহর। তার কাছেও শিক্ষা গ্রহণ করেছি। খুলনা রেডিওর মিউজিক ডিরেক্টর শেখ আলী আহমেদ ও বিনয় রায় ছিলেন খুব নামকরা। পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করেছি।
পেশাদারি হয়ে বাঁশি বাজানো শুরু করলেন কখন থেকে? এই পেশায় এসে আপনি কতটা তৃপ্ত?
১৯৭৩ সালে খুলনা রেডিওতে প্রফেশনালি কাজ শুরু করি। কিন্তু, ১৯৬৬ দিকে নাটক কিংবা যাত্রায় বাঁশি বাজাতাম। তখন মানুষের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা করে পেতাম। অনেক তৃপ্ত আমি। জীবনে একটাই চাওয়া ছিল, সেটাই হতে চেষ্টা করেছি।
উপমহাদেশের বাঁশির সঙ্গে আমাদের এখানকার বাঁশি বাদনের বিষয় সম্পর্কে বলেন?
ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মের একটা অংশই হলো সংগীত। কিন্তু, আমাদের ছোট্ট দেশের একজন হয়ে বাঁশিটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। সাধারণ একজন বাঁশিবাদক হয়ে আন্তর্জাতিক অনেক ফেস্টিভ্যালে বাঁশি বাজিয়েছি।
আপনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি রয়েছে?
সেইভাবে আমার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। তবে, আমাদের দেশে মিউজিশিয়ানদের সত্যি মূল্যায়ন করা হয় না। বাংলাদেশ মিউজিশিয়ান ফাউন্ডেশনের সভাপতি আমি। সারা বাংলাদেশে কতজন মিউজিশিয়ান আছে সেটা বলে দিতে পারি। কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইলে কণ্ঠশিল্পী পায় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। আর একজন মিউজিশিয়ান পায় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এই বৈষম্য কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেই কারণে আজকে বাংলাদেশে কোনো মিউজিশিয়ান তৈরি হচ্ছে না। ১৮ কোটি মানুষের দেশে মিউজিশিয়ান হাতেগোনা কয়েকজন। এই বিষয়গুলোতে মন খারাপ হয়।
সংগীতের দীর্ঘ ৫৫ বছরের যাত্রায় অনেক কিছুই তো দেখলেন। কী মনে হয় নিজের ভেতর?
৫৫ বছরের দীর্ঘ সংগীত জীবনে আদি থেকে শুরু করে বর্তমানের শিল্পীদের সঙ্গেও কাজ করেছি। জানি কী করে তারা গান করেন। একজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, তিনি কোন স্কেলে গান গাবেন। এদেশের এমন কোনো শিল্পী নেই, যার গানের প্রথম ক্যাসেটটি করিনি। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস বড় একটা ব্যাপার। ইন্ডিয়াতে দেখা যায় এক একটা প্রোগ্রাম বড় বড় কোম্পানিগুলো স্পন্সর করেছে। একজন লতাজিকে যতটা সম্মান দেওয়া প্রয়োজন, সরকারিভাবে তাকে সেই সম্মান দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, আমাদের দেশে আমাকে কেন বাজারের ব্যাগ হাতে কাঁচা বাজারে যেতে হচ্ছে। এটাই কি আমার প্রাপ্য? একজন ফরিদা পারভিনকে কেন বাজারের ব্যাগ হাতে বাজারে যেতে হবে। যে কিনা লালনের গানকে আখড়া থেকে তুলে সারা পৃথিবীর ড্রইং রুমে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পীরা দেশের সম্পদ। সরকার, সমাজের উচিত তাদেরকে মূল্যায়ন করা।
আপনার জীবনে স্মরণীয় বাঁশি বাদনের ঘটনাগুলো সম্পর্কে বলেন?
১৯৯৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাঁশি বাজানো। লাভেলো থিয়েটারে আমার ও ফরিদা পারভীনের একটি প্রোগ্রাম। ১৯৯০ সালের ঢালাসে খান আতাউর রহমানসহ একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান— তিন দেশের একটা প্রোগ্রাম ছিল সেটা। মান্না দে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই প্রোগ্রামে। এ ছাড়া, জাপান, প্যারিস, নেদারল্যান্ড, হল্যান্ডের লাইভ প্রোগ্রাম উল্লেখযোগ্য। ফরিদা পারভীন ২০০৮ সালে ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচারালে সংগীতের জন্য সেরা পুরস্কৃত হন। এইগুলো আমার জন্য অনেক স্মরণীয়।
বাঁশিবাদক ছাড়াও আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। কোন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন?
আমি খুলনার ডুমুরিয়া অঞ্চল থেকেই যুদ্ধ শুরু করি। যুদ্ধের সময় দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। তবে, যুদ্ধ কিংবা বাঁশি, আমার জীবনে সবকিছুই করতে পেরেছি মায়ের কারণে। মা আমাকে সব সময় উৎসাহ দিতেন।
করোনাকালে মিউজিশিয়ানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
এটা সত্য যে, সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিউজিশিয়ানরা। এর মধ্যে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। অনেকের বাচ্চাদের ওষুধ কেনার টাকা পর্যন্ত নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ২০০ মিউজিশিয়ানদের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে অনুদানের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু, এই টাকায় কি হয়? আমাদের রেকর্ডিং তো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র, ক্যাসেট, সিডি ধ্বংস হয়ে গেছে। চ্যানেলগুলো যে পয়সা দেয়, সেটা এতই যৎসামান্য যে কাউকে বলাও যায় না।
Comments