সরকারি কাজ পেতে নগদ অর্থ, উপহার আর সফর

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয়ে নিজেদের কাজ পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে নগদ অর্থ, সফর এবং নৈশভোজের ব্যবস্থা করে থাকেন ঠিকাদাররা।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ক্রয়ে নিজেদের কাজ পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে নগদ অর্থ, সফর এবং নৈশভোজের ব্যবস্থা করে থাকেন ঠিকাদাররা।

সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে এবং নিয়মাবলীর কিছু ধারার কারণে ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতাতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বড় ঠিকাদাররা একচেটিয়াভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমের মূল্যায়ন’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক।

২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সরকারের দুই লাখ ৯৬ হাজার ৭৬০টি ই-গভর্নমেন্ট (ই-জিপি) এবং ১২ হাজার অন্যান্য ক্রয়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, জরিপে ঠিকাদারদের প্রায় ৩১ শতাংশ স্বীকার করেছেন যে কাজ পেতে তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যেককে ৩০০ ডলারেরও বেশি উপহারের প্রস্তাব দিয়েছেন।

জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ দরপত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে ২৫ হাজার টাকার উপরে উপহার দিয়েছেন, প্রায় ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেকে ২৫ হাজার টাকার কম উপহার দিয়েছেন, ১৭ শতাংশ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং চার শতাংশ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়েছে, কিছু ঠিকাদার দরপত্র প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য ব্যয় সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। যা অত্যন্ত গোপনীয় থাকার কথা।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে যে ঠিকাদারদের কাছ থেকে উপহার বা অন্যান্য সামগ্রী নেওয়ার অপরাধে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পায়নি তারা।

২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে প্রায় ২৪ দশমিক এক বিলিয়ন ডলারের সরকারি ক্রয় হয়েছে। যা বার্ষিক বাজেটের ৪৫ দশমিক দুই শতাংশ এবং জিডিপির আট শতাংশ।

স্বচ্ছতার জন্য ২০১১ সাল থেকে ই-জিপি পদ্ধতিতে ক্রয় সম্পন্ন করা হয়। তারপরও এখনও প্রত্যাশিত স্তরের স্বচ্ছতার অর্জন সম্ভব হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন অনুসারে, সরকারি ক্রয়ের ৮০ শতাংশ উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির (ওটিএম) মাধ্যমে করা। এর জন্য সম্ভব্য ব্যয়ের ১০ শতাংশ প্রাইস ক্যাপ ধরা হয়। এর অর্থ প্রাইস ক্যাপের ১০ শতাংশ বেশি বা কম দর দেওয়া হলে দরপত্র বাতিল করা হবে।

এর কারণেই প্রক্রিয়াটি কম প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়, উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগী ঠিকাদারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আগে গড়ে চার দশমিক দুই জন ঠিকাদার দরপত্র জমা দিলেও তা নেমে এসেছে দুইটিতে। এছাড়াও একক দরদাতার সংখ্যা ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ঠিকাদারদের একচেটিয়া অবস্থান

প্রতিবেদন অনুসারে, বড় ঠিকাদারদের একচেটিয়া অবস্থানের কারণে ছোট ঠিকাদাররা নিজেদের এই প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিক পণ্য সংগ্রহের পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর ফলে নির্মাণে সমস্যা, দেরি হওয়া এবং ব্যয় বৃদ্ধি হয়ে থাকে।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণগুলো সাম্প্রতিক টিআইবি জরিপের ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তিনি বলেন, ‘ই-জিপিসহ সরকারি ক্রয়ে আধুনিকীকরণের ফলে যে ক্ষমতা এবং সুযোগ তৈরি হয়েছে তা উন্মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বড় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া অবস্থান নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।’

ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকায় ক্রয় প্রক্রিয়ায় এধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হচ্ছে জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ব্যবসায়িক সম্পর্কের উপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

‘মানসিকতার পরিবর্তন দরকার’

সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা যদি অসাধু হই এবং দরপত্র প্রক্রিয়া ও এর আনুমানিক ব্যয় সম্পর্কে আগেই তথ্য দিয়ে দেই তাহলে আইন সংশোধন করে তো আর সমাধান হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সবারই মানসিকতার পরিবর্তন করা দরকার।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তারা এই সমস্যা সমাধানে ইলেক্ট্রনিক কন্ট্রাক্ট ম্যানেজমেন্ট (ই-সিএমএস) ব্যবস্থা আনার চেষ্টা করছেন।

তিনি দাবি করেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে এলজিইডির তিনটি এবং সড়ক ও জনপথের দুটি ক্রয় চুক্তি ই-সিএমএস পদ্ধতিতে করছি। যদি এটা সফল হয় তাহলে আমরা ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা হচ্ছে তা সমাধান করতে সক্ষম হব।’

বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি থেকে ১০ শতাংশ প্রাইস ক্যাপ তুলে দেওয়া এবং ঠিকাদারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া।

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে মূল প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে Govt procurement: Gifts, trips secure contracts

Comments

The Daily Star  | English

Former planning minister MA Mannan arrested in Sunamganj

Police arrested former Planning Minister MA Mannan from his home in Sunamganj's Shatiganj upazila yesterday evening

2h ago