মহাপরিচালকদের চালাতেন যে ড্রাইভার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে রদবদল নিয়মিত ঘটনা হলেও অধিদপ্তরের গাড়ি চালক আব্দুল মালেক টানা এক দশক ধরে দাপট দেখিয়েছেন। অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত গড়ে অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক হয়ে উঠেছিলেন অঘোষিত মহাপরিচালক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন লাইন ডিরেক্টর বলেন, ‘হোক সেটা বদলি বা কার্যাদেশ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকজন ভরসা করতেন মালেকের ওপর। কারণ তারা জানতেন দিন শেষে মালেককে দিয়েই কাজ হবে।’
একজন গাড়ি চালক যিনি কিনা অবৈধ উপায়ে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছে--সারাদেশের আলোচনায় আসেন গত সপ্তাহে আগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মাসিক বেতন যৎসামান্য হলেও প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার সম্পদের পরিমাণ শত কোটি টাকার কম নয় বলে জানা গেছে।
দ্য ডেইলি স্টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কয়েক দফায় কথা বলেছে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কাছে পুরো অধিদপ্তর কিভাবে জিম্মি হয়ে ছিল সে ব্যাপারে তারা জানালেও মালেক কার ক্ষমতাবলে এই আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন সে ব্যাপারে বেশি কিছু জানাতে পারেনি।
অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘মালেক হলো ভাসমান হিমশৈলের চূড়ার একটা অংশ মাত্র। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির আরও কিছু কর্মচারী হয়ত গ্রেপ্তার হবেন। কিন্তু মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, লাইন ডিরেক্টরের মতো বড় কর্মকর্তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন।’
ষাট বছরের মালেক অধিদপ্তরের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাজ করতেন। অধিদপ্তরে কর্মরত ড্রাইভারদের নিয়ে তিনি একটি সংগঠন তৈরি করে এর সভাপতি হন এবং এই পদে নিয়োগ ও বদলিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। অধিদপ্তরের সবাই তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানলেও ভয়ে মুখ খুলতেন না।
তারা জানান, মালেক এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ পর্যন্ত তাকে সমঝে চলতেন। মহাপরিচালকের এমন আচরণে হতাশ হন অধিদপ্তরের বহু চিকিৎসক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা। যেকোনো সরকারি কর্মসূচিতে মহাপরিচালকের পাশে অধিদপ্তরের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের থাকার কথা থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় শোক দিবসে অধিদপ্তরের চত্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় মহাপরিচালকের ঠিক পাশে জায়গা পেতেন মালেক। এতে সবাই অসম্মানিত বোধ করতেন জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক চিকিৎসকই তাই শোক দিবসের অনুষ্ঠান বর্জন শুরু করেছিলেন।
কর্মকর্তাদের হাতে রেখে অবৈধ অর্থের যোগান চালু রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব কার্যক্রম নখদর্পণে রাখতেন মালেক। এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন সেখানকারই কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিভিন্ন অপকর্মে মালেকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন দুজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, দুজন ব্যক্তিগত সহকারী ও কয়েকজন অফিস সহকারী। তারাই নিয়োগ বাণিজ্য ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন।
অফিসের ভেতর মহাপরিচালকের গতিবিধি ও কার্যক্রমের ব্যাপারে মালেককে তথ্য সরবরাহ করতেন মহাপরিচালকেরই ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ শাহজাহান।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আরেকটি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফাইলের তথ্য মালেককে জানাতেন দুই জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও একজন স্টোর কিপার। টাকার বিনিময়ে মালেক এসব ফাইল পাচার করতেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতাকারী কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিনব কায়দা ব্যবহার করতেন মালেক। যিনিই তার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করতেন গণমাধ্যমে তার ব্যাপারে তথ্য ফাঁস করে দিতেন মালেক। খবর প্রকাশ হওয়ার পর প্রত্যেক কর্মকর্তার কাছে তিনি তা পৌঁছেও দিতেন।
সূত্রটি জানায়, এরকম হয়রানির ভয়ে মালেকের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতেন না। এভাবে তিনি শুধু অর্থবিত্তেরই মালিক হননি, তার অন্তত ২৭ জন নিকটাত্মীয়কে বিভিন্ন পর্যায়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন বলেও তথ্য রয়েছে।
মালেক যেসব সম্পদের মালিক হয়েছেন তার মধ্যে আছে রাজধানীতে তিনটি বহুতল ভবন, ২৪টি ফ্ল্যাট, একটি ডেইরি ফার্মসহ অন্যান্য সম্পদ। র্যাবের একটি সূত্র জানায়, এসব সম্পদের অর্থমূল্য ১০০ কোটি টাকারও ওপরে।
২০১৯ সালের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের ৪৫ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর তালিকা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মধ্যে নাম ছিল মালেকেরও।
যেভাবে মালেকের উত্থান
মালেক মাস্টার রোল স্টাফ হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে। ২০০০ সালে সৈয়দ মোদাসসের আলী যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তখন ক্ষমতার প্রথম স্বাদ পান মালেক। তবে অর্থ সম্পদের দিক থেকে তার উত্থান ২০০৯ সালে সাবেক মহাপরিচালক শাহ মুনীর হোসেনের সময়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাবের তদন্তকারীদের একজন জানান, উপজেলা পর্যায়ে সহকারী পরিচালক পদে শতাধিক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মালেক। এখান থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। এ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন শাহ মুনীর নিজেও।
২০১০ সালে খন্দকার মোহাম্মদ শেফায়েত উল্লাহ স্থলাভিষিক্ত হন শাহ মুনীরের। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য একটি ক্যান্টিন খোলার উদ্যোগ নেন মালেক। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টিনের দায়িত্ব নিয়ে তিনি এটিকে তার অঘোষিত কর্মস্থলে পরিণত করেন।
সূত্র জানায়, সাবেক কোনো মহাপরিচালকের গাড়ি চালাতেন না মালেক। তিনি মূলত চালাতেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনের গাড়ি। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হওয়া পর্যন্ত মালেক তারই গাড়ি চালান।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা বিশেষ করে সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতেন মালেক। তবে এ কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'তিনি (মালেক) কী করে এটা বলেন। আমি মালেককে চিনি না। একজন নেতার সঙ্গে একজন গাড়ি চালকের সুসম্পর্ক থাকতে পারে?'
‘কেউ ছাড় পাবে না’
শাহ মুনীর জানান, তিনি যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছিলেন মালেক তখন মতিঝিলে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন।
‘আমি ছিলাম মহাপরিচালক। আর তিনি ছিলেন আমার গাড়ির চালক। তার সঙ্গে কি আমার সুসম্পর্ক সম্ভব? তার সম্পদের ব্যাপারে আমি জানতাম না। গণমাধ্যম থেকে আমি এসব জেনেছি,’ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।
‘কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এখানে আমার নাম জড়ানো হচ্ছে কেন? এটা আমার জন্য বিব্রতকর,’ যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনায়েত হোসেন জানান, মালেক তার সরকারি গাড়িটি চালিয়েছেন চার বছর।
‘আগে পরিকল্পনা বিভাগে ছিলাম আর এখন শিক্ষায়। মালেক যখন আমার ড্রাইভার ছিল তখন আমি কোনো নিয়োগ বা কেনাকাটায় যুক্ত ছিলাম না।’
তবে চেষ্টা চালিয়েও সাবেক মহাপরিচালক আজাদের কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।
যোগাযোগ করা হলে অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, কোনো ধরনের বেআইনি কাজে যুক্ত হলে কেউই ছাড় পাবে না। মালেক একদিনে এই সম্পদের মালিক হয়নি। আগামীতে আরও অনেকেই শাস্তির মুখে পড়বেন।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান
মালেক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৪৪ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছেন দুদকের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল। দুদক পরিচালক কাজী শফিকুল আলম জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের দুর্নীতির কথা সামনে আসার পর এই উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। আবজাল ও তার স্ত্রীর বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৮৪ কোটি টাকার সন্ধান পেয়েছিল দুদক।
মালেকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্যান্যদের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে শফিকুল আলম বলেন, ৪৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে এখন পর্যন্ত ১৭টি মামলা দায়ের হয়েছে।
সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের ৭০ থেকে ৮০ জন--যাদের বেশিরভাগই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী--দুদকের নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমিনুল হাসান, উপপরিচালক ডা. ইউনুস আলী, সহকারী পরিচালক ডা. শফিউর রহমান ও গবেষণা কর্মকর্তা ডা. দিদারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতিই বেশি দৃশ্যমান। সম্প্রতি এরকম কয়েকজনের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। কিন্তু কোনোভাবে এই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা আমাদের জাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সারাদেশে এদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেটি আমরা ভাঙার চেষ্টা করছি।
Comments