প্রবাসে

রাশিয়ার মজার সব খাবার

বাঙালি চিরকালই ভোজন রসিক। আর ভোজন রসিক কথাটা চোখ বন্ধ করে ভাবতে গেলেই বুঝি সেই সাথে ভেসে ওঠে পোলাও, মাংস, মাছ, ঘি, দুধ, ছানা মিষ্টি জাতীয় এসব খাবার। আর প্রবাস জীবনে সেই ভোজন রসিক বাঙালি যদি কোন কারণে থেকেই থাকে সেই দেশেও ‘কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায়! হায়!!’ তবে এসব ছাড়াও যে জীবন চলে প্রবাসীরা সেটা ধীরে ধীরে টের পায়। তারপর একসময় মানিয়ে নেয় নিজেকে।
রাশিয়ার একটি খাবারের দোকান। ছবি: শাকিলা সিমকী

বাঙালি চিরকালই ভোজন রসিক। আর ভোজন রসিক কথাটা চোখ বন্ধ করে ভাবতে গেলেই বুঝি সেই সাথে ভেসে ওঠে পোলাও, মাংস, মাছ, ঘি, দুধ, ছানা মিষ্টি জাতীয় এসব খাবার। আর প্রবাস জীবনে সেই ভোজন রসিক বাঙালি যদি কোন কারণে থেকেই থাকে সেই দেশেও ‘কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায়! হায়!!’ তবে এসব ছাড়াও যে জীবন চলে প্রবাসীরা সেটা ধীরে ধীরে টের পায়। তারপর একসময় মানিয়ে নেয় নিজেকে।

আমার নিজের কথাই বলি, নিজের দেশে থাকাকালীন যে আমি ভাত ছাড়া বাকি সব খাবার পছন্দ করতাম, সেই আমি রাশিয়া আসার পর ভাতের জন্য প্রাণ আইঢাই করতো। মনে হতো কেউ যদি এক থালা গরম ভাত আর ঘি এর সাথে দুটো শুকনো মরিচ ভাজা দিত আহা!! কী সুখ!! কী শান্তি!!   

যাই হোক রাশিয়ার মতো বিশাল এবং  নানাজাতির দেশে এসে উপলব্ধি করলাম, এদের কোন জাতীয় খাবার নেই। তবে আছে ভিন্ন ভিন্ন জাতির মজার সব খাবার। তবে উত্তর-পূর্ব ইউরোপীয়, ককেশিয়ান, মধ্য এশিয়া, সাইবেরিয়ান এবং পূর্ব এশিয়ার প্রভাবে রাশিয়ার খাবারে আছে বৈচিত্র্য। বহু জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বিস্তৃত অঞ্চল থেকে খাবারে এসেছে ভিন্নতা। বৈরি আবহাওয়া এবং কঠোর পরিবেশগত কারণে মৌসুমি ফসলের ওপর কৃষকের খাবার নির্ভর করতো। ফলে গ্রামীণ জনগণ, পরিবেশের সাথে খাবারের একরকমের সংযোগ ঘটিয়েছিল। তাদের খাদ্য তালিকায় মূলত বিভিন্ন শস্য মাছ এবং গৃহপালিত পশুর মাংস এবং নিজেদের তৈরি বিয়ার এবং ভোদকার সরবরাহ।

বিংশ শতাব্দীতে এই জাতীয় খাবার খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৬ থেকে ১৮ শতকের দিকে খাবারে রান্নায় কৌশলে এসেছিল ভিন্নতা। মাছ মাংসে স্মোকড পদ্ধতি, সালাদ, চকলেট, আইসক্রিম, ওয়াইন এসব বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। শহুরে আভিজাত্যের সৃজনশীল এই ইউরোপীয় খাদ্যগুলো রাশিয়ান ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথে নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছিল।   

গ্রামীণ সমাজে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন এখনও বিদ্যমান। সেই সঙ্গে মস্কোর ব্যস্ত শহুরে নাগরিকের মাঝে ইউরোপীয় খাবারের উপস্থিতি থাকলেও, এখানেও আছে রুশদের নানা জাতির নানারকম খাবারের সমাহার।

সেই কথায় একটু পরে আসছি।

রুশরা খাবার নিয়ে এত ঝুট ঝামেলা পছন্দ করে না। আমরা বাঙালিরা রান্না সুস্বাদু করার কিংবা রান্না নিয়ে যত সময় খরচ করি তার চার ভাগের এক ভাগ সময় রুশরা খরচ করে রান্নাতে। একটি কড়াইতে সামান্য তেল, বা ইচ্ছে না হলে তেল ছাড়াই বেশ কিছু আলু কেটে লবণ ( ইচ্ছে হলে ) ছিটিয়ে ঢাকনা দিয়ে চুলোয় বসিয়ে দেয়। সেদ্ধ হলে নামিয়ে নেয়। এটিই ডিনার। ডর্মের বেশির ভাগ ছেলে মেয়েকে দেখি এই খাবার ডিনারে হিসেবে খেতে। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে স্যুপ রান্না করে। রুশদের প্রিয় খাবার স্যুপ। এক করাইতে পানি চুলায় বসিয়ে পরিস্কার করা পুরো একটা মুরগি দিয়ে তাতে আলু আর টমেটো দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ হবার পর মুরগিটা উঠিয়ে নেয়, বাকি জ্বাল দেয়া পানিটাই স্যুপ। এর নাম ‘বুলিয়ন’। বলে রাখি, সেই স্যুপে কিন্তু লবণ দিতে হয় না।

এছাড়া কাশা, গ্রেজকা, পেলমেনি, তেল ছাড়া চিকেন ভাজাও আমার ডর্মের রান্নাঘরে চলে। মাঝেমাঝে আমার দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাত তরকারি রান্না দেখে কেউ কেউ মুচকি হাসে। 

এবার একটু আগে ফিরে যাই, পরিচয় করাই রুশদের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার, ‘পেলমেনি’ (Pelmeni) রাশিয়ান ট্রাডিশনাল খাবারের সঙ্গে। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে এই পেলমেনি পুরো ইউরোপ, রাশিয়া জুড়ে প্রধান খাবার হয়ে উঠেছিল।

পেলমেনি হচ্ছে মম বা মান্তি গোত্রের খাবার। পাতলা ময়দা দিয়ে আবৃত ভেতরে কাঁকড়ার মাংস অথবা শুকরের মাংস, ডিম অথবা মিশ্র মাংসের পুর দেয়া থাকে। শীতকালে অনেকদিন থাকে বলে গ্রামীণ লোকদের কাছে জনপ্রিয় একটি খাবার এমনকি মস্কোতেও খুব জনপ্রিয়।

রুশদের আরেকটি ঐতিহ্যবাহি খাবার হলো পরিজ (Porridge)। রুশ ভাষায় একে বলে ‘কাশা’ (Kasha)। এটিও শুধু গ্রামীণ নয় শহুরে মানুষেরও খুব প্রিয় খাবার। কম সময়ে কাশা তৈরি করা যায় বলে কি ব্যস্ত রুশবাসীর প্রিয় খাবার কি না জানি না। তবে পুষ্টিকর তো অবশ্যই। গম, রাই, যব নানা রকম ফসলের সংমিশ্রনে কাশা তৈরি হয়। সাথে মেশানো থাকে নানারকম শুকনো ফলের গুঁড়ো। গরম দুধে মিশিয়ে খানিক জ্বাল দিলেই কাশা তৈরি। আর কাশা পরিবারে ওটস, বার্লি, জাউ ভাত, সুজি আছে । যাদের তৈরি করতে হয় একই নিয়মে আর মূল উপাদান হচ্ছে দুধ। আর সময় স্বল্পতা অধিক পুষ্টির কারণে রুশ শিক্ষার্থীদের কাছে কাশা জনপ্রিয় খাদ্য।

রুশদের খাবারে স্যুপ অন্যতম। নানারকম সবজি এবং মাশরুম দিয়ে তৈরি এই স্যুপগুলো খুব স্বাস্থ্যকর তবে রাসোলনিক নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহি স্যুপ যা  কিনা তৈরি হয় টক শশা, গরু অথবা শুকরের কিডনি দিয়ে। সোভিয়েত সময়ের প্রধান খাবারে পরিণত হয়েছিল এই রসোলনিক স্যুপ। এছাড়া লাটসা নামের এক ধরনের নুডলস স্যুপ, বুলিয়ন, শচি, উখা নামক নানা ধরনের স্যুপ আছে।

বাঙালি খাবারে তেল এবং ঘি এর যেমনটা আধিক্য ঠিক তার উল্টো রুশ খাবারে। রুশদের খাবার মেন্যুতে সালাদ একটি আবশ্যকীয় আইটেম। এরমধ্যে সবচে জনপ্রিয় হচ্ছে অলিভিয়ে (Olivier) সালাদ। ডাইসড সেদ্ধ আলু, গাজর, মটর, ডিম, সেদ্ধ মুরগি, আপেল, পেয়াজ, লবণ, গোলমরিচ দিয়ে মেয়নিজ মিশ্রনে এই সালাদ খুবই জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু।

শীতের দেশ রাশিয়ায় ঠান্ডা সহিষ্ণূ সবজি বাঁধাকপি, আলু শসা, টমেটো অন্যতম। এছাড়া টমেটো, অলিভ, শসা, নানারকম মৌসুমি ফল ভিনেগারে ভিজিয়ে জারে সংরক্ষণ করে সারা বছর। রাশিয়ায় আলুর ফলন বেশি তাই আলু দিয়ে নানারকম খাবারেরও আধিক্য রুশদের কাছে। রুশ ভাষায় একে বলে ‘কার্তোফেল’। আলুর স্যুপ ছাড়াও একধরনের স্ন্যাকস আছে বান এর ভেতরে স্ম্যাশড আলুর যার নাম ‘কার্তুশকা’।

রুশরা ঝাল একদমই খায় না বললে চলে। তাই তাদের খাবারে নেই ঝালের কিংবা মশলার ছিটেফোঁটা । লবণ কিংবা প্রক্রিয়াজাত শুকনো কারি পাতার গুড়ো দিয়ে মাংস কিংবা ডিম ভেজে খায়। বরং মিষ্টি জাতীয় খাবার রাশানদের ভীষণ প্রিয়। তাই  নানারকম তর্ত অর্থাৎ পিঠা, পেস্ট্রি আর চকোলেট তাদের নিত্যসঙ্গী। রুশ পরিবারে কিংবা আড্ডায় বিকেল বেলা চায়ের সাথে এই তিন আইটেম থাকবেই।

পিঠার মধ্যে সবচে জনপ্রিয় হচ্ছে পিশকা (Pyshka) রাশিয়ান ডোনাট। রাশানরা চকলেট উপহার দিতে এবং পেতে দুটোই পছন্দ করে। এবার একটু পানীয়তে আসা যাক। চলিত পানীয় কম্ফোট। নানা রকম ফল সেদ্ধ করে সেটার পানীয় তাদের খাবার টেবিলে নিত্য থাকে। কিসেলস (kissel) জনপ্রিয় ডেজার্ট মধুর সাথে ময়দার রস মিশ্রিত মিষ্টি। ফলের রস দিয়ে মিশ্রিত পানীয় মর্স (Mors)। সবিটেন(Sbiten) মধু, ফলের রস এবং মশলা মিশ্রিত পানীয়। আসলে শীতের দেশে পথে ঘাটে নানারকমের ফল দেখেছি। জেনেছি এইসব বেশির ভাগ ফল প্রক্রিয়া করে এইসব পানীয়তে কাজে লাগায়। আর এছাড়া বিয়ার , ভোদকার কথা নাই বললাম। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যালকোহল ছাড়াও নানারকম উপাদানে রুশ গ্রামবাসী নানারকম পানীয় এবং  ভোদকা, বিয়ার পান করে যা কিনা দামাসনিয়া অর্থাৎ বাড়িতে তৈরি।

শীতের দেশে গরম চা না হলে চলে?  রাশিয়াও সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।  রাশিয়ার সবখানেই চা সবচেয়ে সাধারণ পানীয়। বিশ্বের বৃহত্তম চা ভোক্তাদের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। শুনেছি, রুশরা হাল্কা লিকারে চা পান করে। আর কড়া লিকারে যে চা তৈরি হয় সেটা নাকি কেবল জেলখানার কয়েদিদের জন্য। রাশিয়ান কারয়ান বিশ্ব পরিচিত রাশিয়ান চা। পাশাপাশি কফিও  দারুণ জনপ্রিয়। তবে  কফি এখন পর্যন্ত  চা এর জায়গা নিতে পারেনি রুশদের মনে।  

মস্কো শহরে আছে প্রচুর রেস্তোরাঁ। যেখানে রাশিয়ান নানা জাতের নানান খাবার পাওয়া যায়। সেইসব রেস্তোরাঁতে ঢুকলে তেল ঘি বিহীন খাবারগুলোও আপনার জিভে জল আনবে আমি নিশ্চিত। দাম একটু বেশি তবে সেখানে ঐতিহ্যবাহি খাবারগুলোর পাশাপাশি আধুনিক ইউরোপীয় ধাঁচের খাবারও আছে সুসজ্জিত। আপনার কাজ শুধু বাছাই করা। মস্কো শহরে শর্মা খুব চলে তাছাড়া সুশি আর আইসক্রিম এ দুটো খাবারও সমান জনপ্রিয়। আইসক্রিমের কথা বলতেই হয়। রুশ ভাষায় এর নাম ‘মারুসজনে’। কনকনে ঠান্ডায় গলায় মাফলার জড়িয়েও তারা আইসক্রিম খায়। শীত, গ্রীষ্ম সারাবছরই আইসক্রিমের দোকানগুলোতে লেগে থাকে ভীড়।

(লেখক: শাকিলা সিমকী, রাশিয়ায় পিএইচডি অধ্যায়নরত)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

4h ago