তিতাস একটি বিপর্যয়ের নাম

ভবনের গ্যাস সংযোগ পরীক্ষা করতে শেষবার কবে তিতাসের কেউ এসেছিলেন তা মনে করতে পারেননি সিরাজুল হক খান।

ভবনের গ্যাস সংযোগ পরীক্ষা করতে শেষবার কবে তিতাসের কেউ এসেছিলেন তা মনে করতে পারেননি সিরাজুল হক খান।

যাত্রাবাড়ীর পারগেন্ডারিয়ার ৭৩ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী গত ৩৯ বছরে তার এলাকায় গ্যাস লাইন পরিদর্শন করতে দেখেননি।

সিরাজুল হক বলেন, ‘এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের লোকজন বেশ কয়েকবার এসেছে সুয়ারেজ লাইনের কাজ করতে, কিন্তু তিতাস গ্যাস থেকে গ্যাস সংযোগ পরীক্ষা বা লাইনের উন্নয়ন কাজ করতে কাউকে আসতে দেখিনি।’

‘গ্যাস লিক হয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে তাদের আনাগোনা দেখতে পাই,’ যোগ করেন তিনি।

৬০ শতাংশ গ্যাস সংযোগ নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাস বিতরণ সংস্থা হওয়ার পরও তিতাসের ভূগর্ভস্থ গ্যাস পাইপলাইনগুলোর বিশাল নেটওয়ার্ক থেকে কোনো লিক চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নেই।

সরকারি মালিকানাধীন এই সংস্থাটি শুধুমাত্র গ্রাহকদের কাছ থেকে লিকের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পরেই কাজ করে।

সেক্ষেত্রেও তিতাস কর্মকর্তারা যে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়, তা নয়। কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগ, স্থানীয় প্লাম্বারদের মাধ্যমে এসব লিক ঠিক করতে বাধ্য করেন তিতাস কর্মকর্তারা।

জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা জানান, এই জাতীয় অভিযোগ বছরের পর বছর ধরে একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তিতাসের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ব্যবস্থাপনা যে কতটা খারাপ তারই ইঙ্গিত দেয়।

তারা মনে করেন, ঘন ঘন আগুন লাগার ঘটনা এবং গত মাসে নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ছিল দেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণকারী কর্তৃপক্ষের বছরের পর বছর অবহেলা ও অব্যবস্থাপনারই কারণে।

অবহেলা

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর নেটওয়ার্কে ১৩ হাজার ১৩৮ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন, ৬২৪ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন এবং ১২ হাজার ৫১৪ কিলোমিটার বিতরণ লাইন রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে প্রায় ২৮ লাখ ৬৬ হাজার স্থানীয় ও শিল্প গ্রাহক।

তিতাসের সরকারি নথি অনুসারে, মোট সার্ভিস লাইনের মধ্যে সাত হাজার এক কিলোমিটার লাইন নির্মাণ হয়েছে ২০০০ সালে। এর সবচেয়ে দীর্ঘ সার্ভিস লাইনের দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার, যা ঢাকায় রয়েছে।

তিতাস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোট গ্যাস পাইপলাইনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ২৫ থেকে ৪০ বছর আগে লাগানো। সেগুলো মরিচা ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা বিতরণ লাইনে।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংস্থাটির সিস্টেম অপারেশন বিভাগ নামে একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। তবে তাদের লিক শনাক্ত করার কোনো ডিভাইস না থাকায় ভোক্তাদের অভিযোগের উপর নির্ভর করতে হয়।

অভিযোগ জানানোর জন্য তাদের একটি কল সেন্টার রয়েছে। যেখানে গড়ে মাসে ৩৭৫টি জরুরি এবং ৫০টি সাধারণ কল আসে বলে জানান একজন কর্মকর্তা।

আশ্চর্যজনকভাবে, তিতাসের কাছে বিস্তারিত সার্ভিস লাইন ম্যাপ এবং বদল করা পাইপলাইনের কেন্দ্রীয় ডাটাবেস নেই।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ লাইনে লিকের সঠিক তথ্য এই মূহৃর্তে আমাদের কাছে নেই।’

তবে তিন বছর আগে তিতাস পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এর পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার গ্যাস রাইজারের মধ্যে ৩৫ হাজারটিতে লিক রয়েছে।

তিতাসের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত এই রাইজার ঠিক করা হয়েছে বলে কোনো তথ্য তার কাছে নেই।

জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রস্তুতকৃত পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১৬ তে গ্যাস ট্রান্সমিশন ও বিতরণ অবকাঠামোর এই খারাপ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছিল।

একটি স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য হিসেবে, পিএসএমপি-২০১৬ সুপারিশ করে যে ২০১৯ সালের মধ্যে গ্যাসের যথার্থ ব্যবহারের জন্য উন্নত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে ট্রান্সমিশন এবং বিতরণের ইলেক্ট্রনিক্যাল ম্যাপ করা উচিত।

গ্যাস লিকের ঘটনা সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ঘটনার সম্ভাব্য কারণ ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার এবং/বা নিম্নমানের নির্মাণ অনুশীলন।

এতে আরও বলা হয়েছে, ‘দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধে গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো থেকে গ্যাস লিক এবং সিস্টেম লস সম্পর্কে আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

পিএসএমপি-২০১৬ তে দেওয়া সুপারিশের চার বছর পেরিয়ে গেলেও অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, সরকার মূলত ব্যয়বহুল জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনের কারণে গ্যাস সংক্রান্ত আগুনের ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে এবং বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছর ২৪ হাজার ৭৪টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হুসেন বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে ১৯ শতাংশ দুর্ঘটনা গ্যাস সম্পর্কিত, আরও ভেঙ্গে বললে গ্যাস লিকের কারণে।’

তিতাসের দাবি, তাদের বিতরণ এলাকায় ২০১৮-২০১৯ এ ২০৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

‘জনগণের শত্রু’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম দুটি কারণের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এর একটি অবৈধ সংযোগে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার এবং পুরানো পাইপলাইনগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য কোনো প্রচেষ্টা না করা।

অবৈধ গ্যাস লাইনের নেটওয়ার্ককে টাইম বোমা অভিহিত করে তিনি বলেন, এটি তিতাস কর্মকর্তাদের তৈরি, যারা ‘সেবা প্রদানের চেয়ে দুর্নীতির প্রতি বেশি আগ্রহী’।

তিনি বলেন, ‘তারা দায়বদ্ধ নয়। গ্যাস পাইপলাইনের অবৈধ নেটওয়ার্ক তাদের সৃষ্টি। তিতাস যদি তাদের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ না করে তবে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

অধ্যাপক বদরুল পরামর্শ দেন, পাইপলাইন গ্যাসের বোঝা নিরসনে সরকার এলপিজির মতো জ্বালানী কম দামে দিতে পারে ভর্তুকি দিয়ে হলেও।

তিতাস কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি পরামর্শদাতা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের লোভের কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিতাস জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লিক ঠিক করাতে ঘুষ দিতে হবে এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে। তারা নিম্নমানের গ্যাস সরবরাহ করছে কিন্তু, অবৈধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ দিয়ে উদরপূর্তি করছে।’

তিনি দাবি করেন, ঢাকা শহরে ৭০ হাজার পয়েন্ট দিয়ে গ্যাস লিক করে দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ ও অবৈধ সংযোগের কারণে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম তামিম মনে করেন, তিতাসের মূল সমস্যাটি পরিচালনাগত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তামিম বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগ, গ্যাস লাইন লিক, দুর্নীতি- সবই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। দুর্নীতি হলে অবৈধ সংযোগ থাকবেই।’

অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসাসহ অন্যান্য সেবা সরবরাহকারীদের দোষ দিয়েছেন যে, তারা তাদের উন্নয়নমূলক কাজের সময় তিতাসের পাইপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অন্যান্য সেবা সরবরাহকারীরা যখন কাজ করেন, তারা তাদের অজান্তেই কিছু লিক তৈরি করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে সমস্ত গ্যাস-লিক পয়েন্ট চিহ্নিত করতে এবং এক মাসের মধ্যে সেগুলো মেরামত করতে নির্দেশনা দিয়েছি।’

তিতাসের ডিরেক্টর অপারেশন রানা আকবর হায়দারি বলেন, ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এলাকায় মেট্রোরেলের মতো বেশ কয়েকটি উন্নয়নমূলক কাজ চলছে, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে লিক হয়েছে। তবে কিছু লিক এমনিতেই হয়েছে।’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ লাইন পুরনো এবং এগুলো বদলানো দরকার।

বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে তিনি জানান, সারা দেশে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস পাইপলাইন রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এতে তিতাসের দায়িত্ব রয়েছে এবং তাদের যদি কোনো গাফিলতি থাকে সেজন্য শাস্তি দেওয়া হবে। তবে তিতাসও সব কিছু করতে পারে না। অন্যান্য সেবা সরবরাহকারীরা আছে না? আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

মন্ত্রী জানান, গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থাকে সহজতর করার জন্য পুরানো পাইপলাইন পরিবর্তন করতে সরকার এক হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

প্রকল্পের আওতায় গ্যাস ট্রান্সমিশন ও বিতরণ ব্যবস্থা সুপারভাইজারি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা অ্যাকুইজেশন (এসসিএডিএ) সিস্টেমের আওতায় আসবে।

এসসিএডিএ সিস্টেম চালু হওয়ার পর গ্যাস লাইনে লিক বা যে কোনো স্থানে অবৈধ সংযোগের তথ্য তাত্ক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যাবে বলে জানান নসরুল হামিদ।

Comments