উপাচার্যের ‘অ্যামেজিং তত্ত্ব’ এবং ৪ জনের এক রুমে ৪০-৫০ জন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের হওয়া খরচের বিষয় নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের হওয়া খরচের বিষয় নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ফরেন ডেলিগেটরা (বিদেশি প্রতিনিধি) এখানে এলে যখন উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক হয়, তখন আমি তাদের বলি আমাদের ৮৪টি বিভাগ, ১১টি ইনস্টিটিউট, প্রায় ৬০টি গবেষণাকেন্দ্র, ১৪০টি অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলো শুনে তারা অবাক হয়ে যান। তারা বলেন, “ইটস অ্যা হিউজ অ্যান্ড ম্যাসিভ ইউনিভার্সিটি।” আমাদের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ হাজার, শিক্ষার্থীরা ১২ টাকায়, ১৫ টাকায় পড়ে—ইটস অ্যামেজিং, রেকর্ড।’

সব শিক্ষার্থীর যেন শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়, সেজন্য দীর্ঘসময় ধরেই ঢাবির পড়াশোনার খরচ অনেক কম। একই কারণে কম এখানকার খাবার ও ছাত্রাবাসের খরচও। এটি নতুনভাবে আলোচনার বিষয় কি না, জানতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে ঢাবির সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসানের সঙ্গে। আলোচনায় উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় পিছিয়ে পড়ার বিভিন্ন কারণসহ নানা দিক।

অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে টাকা দিয়ে পড়াশোনা করেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের হিসেবে অপ্রতুল। সেটি প্রতুলতা পাবে তখনই যখন তা এক হাজার, দুই হাজার বা তিন হাজার করা হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার্থীরা যখন চাকরি করে, তখন বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তার ঋণের কিস্তি নেওয়া হয়। কম বেতনের চাকরি করলে টাকা কাটা শুরু হয় না।’

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তার মান, র‌্যাংকিং। গবেষণার দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের জন্য গবেষণাই বেশি প্রয়োজন। এর সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থী, বিদেশি ফ্যাকাল্টি, কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোলাবেরেশন আছে, কোন সাইটের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়—এগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখন করোনাভাইরাসের ড্রাগ ডিসকভারিতে কেউ যদি সম্পৃক্ত হতে পারত, তাহলে একেবারেই সেটা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারত। কিন্তু, সেটা করতে গেলে তো ইনভেস্টমেন্ট দরকার। সেটা সরকার থেকেই আসুক, পাবলিক থেকেই আসুক কিংবা প্রাইভেট থেকেই আসুক, আসতে হবে।’

গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাজেট রয়েছে, তা অপ্রতুল বলেই মনে করেন অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা সিরিয়াসলি গবেষণা করতে চাই, সেই অনুপাতে ফান্ডিং নেই। আবার এটাও ঠিক, সবাই যে গবেষণাকে সিরিয়াসলি নেয়, তাও না। কিছু কিছু প্রকল্পে আমি ছেলে-মেয়েদের গবেষণা করালে তারা কিছু অর্থায়ন পায়। সেটা একেবারেই কম না। সে হিসেবে সরকারও এগিয়ে আসছে। কিন্তু, যেভাবে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত, শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসা উচিত, শিক্ষকদের সিরিয়াস হওয়া উচিত, সেভাবে হচ্ছি না।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণায় অন্তরায়গুলো কী এবং সেখানে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কোনো প্রভাব ফেলছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘রাজনীতি এখানে একদম প্রভাব ফেলছে না, তা আমি বলতে পারব না। তবে, গবেষণা করার জন্য পারিপার্শ্বিক ল্যাব এবং অন্যান্য ইনসেন্টিভেরও বিষয় আছে।’

যারা গবেষণা করছেন, গবেষণাপত্র বিভিন্ন উচ্চমান-সম্পন্ন জার্নালে প্রকাশ করছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।

ঢাবির কতগুলো গবেষণাপত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত জার্নালে প্রকাশ পাচ্ছে?, জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘যা প্রকাশ পায়, তা পর্যাপ্ত নয়।’

শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পখরচে যে সেবার কথা বলা হচ্ছে, তার প্রতিফলন ছাত্রাবাসে আছে কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রাবাসের অবস্থা ভালো না, এটা অনেকাংশেই সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের অধিকাংশই চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন এবং ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বাবদ। হলের যে ভাড়া, তাতে বলতে গেলে সেটা প্রায় বিনা মূল্যে। শিক্ষার্থীদের আমি বলব, তাদের জন্য যত টাকা জনগণ দিচ্ছে, সেটা যেন তারা মনে রাখে। এতে করে তাদের দেশাত্মবোধ বাড়বে।’

শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘নরওয়ে, সুইডেন, জার্মানিতে পড়াশোনা প্রায় বিনা মূল্যেই হয়। আর শুধু শিক্ষার্থীদের বেতনের হিসাব এটা না, তাদের অভিভাবকরা তো ট্যাক্স দেয়। সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় চলে।’

শিক্ষার্থীরা কত টাকা বেতন দেন, সেটা না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেট কতটা অপ্রতুল সে বিষয়ে কথা বলা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বলা উচিত ছিল পৃথিবীর যত ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের একটি রিসার্চ গ্রুপের বাজেট আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের থেকে বেশি। এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ের বিষয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কত, কয়টা বিভাগ আছে, কয়টা ইনস্টিটিউট আছে সেটা বিষয় না। এখানে মান বিবেচ্য। আমাদের ৬০টা গবেষণাকেন্দ্র আছে। ৬০টা না, চারটা গবেষণাকেন্দ্র থাকলেই র‌্যাংকিংয়ে অনেক উপরে ওঠা যায়, যদি ঠিক মতো গবেষণা করা হয়।’

৬০টি গবেষণাকেন্দ্র থাকার পরও সবচেয়ে কম স্কোর পাওয়াকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘শ্রীলংকার ইউনিভার্সিটি অব পেরাডেনিয়ার ওয়েবসাইটে দেখলাম, তাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাবে পিএইচডি ছাড়া কোনো শিক্ষকই নেই। আমাদেরও মান বাড়াতে হবে, সংখ্যা না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বাজেট এবং তার বণ্টন নিয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খুবই সামান্য। বাজেট অল্প থাকলেও তা বণ্টন একটি ব্যাপার। এই বাজেট কি আমি সবাইকে সমান পরিমাণে বণ্টন করে দেবো? গবেষণার বাজেট তো আর বেতনের অংশ না। কিন্তু, আমাদের এখানে শিক্ষকদের একটি গবেষণা ভাতা দেওয়া হয়।’

যিনি গবেষণা করবেন, তিনিই কেবল এই বাজেটের টাকা পেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি। এর জন্য প্রকল্প নিয়ে সে অনুযায়ী অর্থ বণ্টন করা উচিত বলে যোগ করেন পদার্থ বিজ্ঞানের এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, ‘যে গবেষণা করে তাকেও টাকা দিলাম, যে গবেষণা করে না তাকেও দিলাম। এতে করে যে গবেষণা করে তার এটা দিয়ে কিছুই হয় না, আর যে গবেষণা করে না, সে এটাকে বেতনের অংশ মনে করে।’

গবেষণা কম হওয়ার বিষয়ে অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘যারা বিভিন্ন জার্নালে পাবলিকেশন প্রকাশ করছেন, তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পান না। যারা গবেষণা করছেন তাদের গবেষণা ভাতা না দিয়ে একটা ইনসেনটিভ দেওয়া হোক। এতে করে সম্মান, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা সবার ভেতরে গবেষণার প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি করবে।’

শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই গবেষণা থেকে দূরে সরে আসছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে আমার কাজ হলো শিক্ষার্থীদের পড়ানো এবং গবেষণা করা। সেটা না করে আমি যদি টক শো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব আর রাজনীতিতে সময় দেই, নির্বাচন করি, তাহলে গবেষণার কী হবে! গবেষণার কাজ যখন করি তখন যেমন আমার মাথা সেখানে ব্যস্ত থাকে, যখন গবেষণার কাজ করি না তখনো আমার মাথা গবেষণার বিষয়ে চিন্তায় ব্যস্ত থাকে। এই চিন্তা যদি না করি, তাহলে আমার গবেষণা জীবনেও হবে না। আমি যদি রাজনীতির জন্য সময় দেই, তাহলে তো আর চিন্তা করার জন্য সময় দিতে পারব না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের কথা জানাতে না পারলেও জার্নালে পাবলিকেশনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক কামরুল হাসান নিজের বিভাগের অবস্থানটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পদার্থ বিজ্ঞানে পৃথিবীর সবচেয়ে বনেদি যে জার্নালগুলো আছে, সেখানে আমার মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের দিয়ে যতটা সম্ভব গবেষণাপত্র প্রকাশ করাই।’

ছাত্রাবাসের পরিস্থিতি নিয়ে ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘ছাত্ররা পড়াশোনা করতে এসে গণরুমে থাকে, চার জনের একটি রুমে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকে। এমন অমানবিক অবস্থায় শিক্ষার্থীরা থাকে, সেটা তো গর্বের বিষয় না। সেটা নিয়ে তার (ভিসি) কথা বলা উচিত ছিল।’

উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘কোরিয়াতে ছাত্রাবাসগুলো থ্রি স্টার হোটেলের মতো। সেখানে আমাদের ছাত্ররা কী অমানবিকভাবে থাকে। তারপরও যে তারা কোনো আন্দোলন করে না, সেটা আমাদের কপাল। অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে, এমন নিম্নমানের জায়গায় থেকেও যে তারা পড়াশোনা করে এবং অনেকেই ভালো ফলাফল করে সেটা আশ্চর্যের বিষয়।’

Comments

The Daily Star  | English

Former planning minister MA Mannan arrested in Sunamganj

Police arrested former Planning Minister MA Mannan from his home in Sunamganj's Shatiganj upazila yesterday evening

1h ago