গগন হরকরা: আমি কোথায় পাবো তারে

ছবি: স্টার

খালি পায়ে, এক হাতে বর্শা— তার মাথায় ছোট একটা ঘণ্টা, একই হাতে অন্ধকারে পথ দেখাতে লণ্ঠন। আর পিঠে চিঠিপত্রের ঝুলি নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ডাকহরকরা।

কুষ্টিয়া শহরের নিশান মোড়ে এমনি এক ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে ডাকহরকরার জীবন। ইতিহাসে ঠাঁই নেয়া ডাকহরকরা পেশা আর এই জেলারই কৃতি সন্তান গগন হরকরাকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই উদ্যোগ, বলছে পৌর কর্তৃপক্ষ।

গগন হরকরা- পরিবারের দেওয়া নাম গগণচন্দ্র দাস হলেও ইতিহাসে যিনি গগন হরকরা নামেই প্রসিদ্ধ। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামে আনুমানিক ১৮৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন গগন। শিলাইদহ পোস্ট অফিসে কাজ করতেন ডাকহরকরা বা ডাকপিয়ন হিসেবে। তবে এই পরিচয় ছাপিয়ে গগন ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তার রচিত ও সুরারোপিত কালজয়ী গানের জন্য।

যেভাবে ইতিহাসে উঠে আসেন গগন

তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের নদীয়ার একটি ছোট গ্রামে গগনের বাস। ভূ-খন্ডের এই অংশে তখন প্রতিনিধিত্ব লালন সাঁই, গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের মতো কালজয়ী প্রতিভাদের। শিলাহদহ এস্টেটে ঠাকুরবাড়ির জমিদারি দেখাশোনার জন্য আসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শিলাইদহ পোস্ট অফিসে ডাকহরকরার কাজের ফাঁকে গান রচনা ও গাইতেন গগন। তিনি বাউল সম্রাট ফকির লালনের অনুসারী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে এলে চিঠিপত্রাদি দিতে জমিদার কাচারিতে যাওয়া হতো গগনের। তার রচিত ও সুরারোপিত ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি শুনে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ গগণের নাম ও তার গানের বিষয়ে তার প্রবন্ধ “An Indian Folk Religion” এ উল্লেখ করেন। সেখানে ‘আমি কোথায় পাবো তারে’—গানটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind.”

এই গান তাকে এতোটাই প্রভাবিত করে রবীন্দ্রনাথ যার সুরে রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।

ডাক ব্যবস্থা ও ডাকহরকরা

এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই সংবাদ আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা চালু ছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত চিঠিপত্র আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ডাকহরকরাদের। বাংলা ‘ডাক’ কথার অর্থ ‘আহবান করা’ বা ‘মনোযোগ আকর্ষণ করা’। আর এই শব্দ থেকে ‘ডাকব্যবস্থা’, ‘ডাকঘর’, ‘ডাকহরকরা’ এবং ‘ডাকমাশুল’ শব্দের উদ্ভব।

আরো পরে ডাকহরকরা শব্দটি ‘ডাকপিওন’ বা পোস্ট পিওন’ নামেও পরিচিতি পায়। আমাদের দেশের ডাক বিভাগের যে প্রতীক- একজন রানার বা ডাকপিয়ন খালি পায়ে, চিঠির ঝুলি ছুটে যাচ্ছে- তা সেই  বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে এসব চিঠি বা সংবাদ পৌঁছে দেয়ারই প্রতীক।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে ডাকব্যবস্থাও। চিঠির বস্তা পিঠে ডাকবহন এখন লুপ্ত পেশার নাম। কেবল ইতিহাস।

আর সময়ের সেই স্মৃতি ধরে রাখতে, দেশের নতুন প্রজন্মকে সেই ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে কুষ্টিয়ায় ডাকহরকরার ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে।

ভাস্কর্যটির বিষয়ে কথা বলেন কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন কুষ্টিয়া পৌর মেয়র আনোয়ার আলীর পরিকল্পনাতেই এই মাটির এক সন্তানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এই উদ্যোগ।

মেয়র আনোয়ার আলী জানান, বাঙালী সংস্কৃতির সৃষ্টি ও সমৃদ্ধি এইসব মানুষদের হাত দিয়েই হয়েছে। এই প্রজন্মের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই এই উদ্যোগ।

গগন হরকরার মতো ডাকহরকরাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এই প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় তুলে ধরা হয়েছে, হাজারো দু:খ-কষ্ট পেরিয়ে সবার কাছে পৌঁছে যাক সুখবর।

Comments

The Daily Star  | English

Tax officials protest at NBR headquarters over draft revenue law

Several hundred tax and customs officials staged a demonstration at the National Board of Revenue (NBR) headquarters in Dhaka today, demanding revisions to a draft ordinance that proposes dividing the board into two separate divisions and allowing top appointments from outside the revenue cadre.

44m ago