ই-সেন্টার করেও সাড়ে ৮ হাজার ডাকঘর থেকে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কৈলাইন ইউনিয়ন পরিষদের পাশে দুই কামরার একটি পাকা ভবনে লেখা ‘তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর’।
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কৈলাইন ইউনিয়নের ডাকঘর। ছবি: স্টার

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কৈলাইন ইউনিয়ন পরিষদের পাশে দুই কামরার একটি পাকা ভবনে লেখা ‘তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর’।

মানুষকে বিভিন্ন ধরনের আইটি সেবা দিতে সারা বাংলাদেশে যে সাড়ে আট হাজার ডাকঘরকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে, তার মধ্যে কৈলাইন ডাকঘর একটি।

কিন্তু, গত মাসের শেষ সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরের সব দরজা-জানালা খোলা থাকলেও বাইরের কলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া। মানুষজনের আনাগোনা নেই। বন্ধ ফটকের সামনে গোবর আর খড় শুকাতে দিয়েছেন স্থানীয় এক নারী।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করার পর পোস্টমাস্টার মশিউর কবির এলেন; তবে ডাকঘরে কী ধরনের সেবা তারা দেন, সেটা জানাতে পারলেন না। জানালেন, তার কাছে পোস্টঅফিসের চাবিই নেই। যার কাছে চাবি, তিনি পাশের গ্রামে গেছেন।

স্থানীয়রা জানালেন, মশিউর স্থানীয় বাজারে নিজের ফার্মেসিতে বসেন। সারাদিন ডাকঘরে তালাই দেওয়া থাকে। তারা জানেনও না, এখানে কী ধরনের সেবা পাওয়ার কথা।

ডাক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট বলছে, কম্পিউটার কম্পোজ থেকে শুরু করে ছবি প্রিন্ট, স্ক্যান, ই-মেইল, অনলাইনে পরীক্ষার ফল জানার জন্য মানুষ পোস্ট ই-সেন্টার ব্যবহার করবে। তা ছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা উত্তোলন, এজেন্ট ব্যাংকিং ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মতো কাজও সেখানে হওয়ার কথা।

দুর্ভাগ্যবশত ডাকঘরগুলো থেকে এ ধরনের কোনো সেবাই পান না প্রান্তিক মানুষেরা। এই চিত্র শুধু কৈলাইনের নয়, প্রায় ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অধীন সাড়ে আট হাজার ডাকঘরের বেশিরভাগগুলোর। সরকারেরই একাধিক তদন্ত কমিটি বলছে, দুর্নীতি আর অর্থ তছরুপের কারণে প্রকল্পটি যথাযথ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামে প্রকল্পটি ২০১২ সাল থেকে শুরু হয়। কাগজে কলমে ২০১৭ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।

ডাক অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়, তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম (২০১৫-১৮) দায়িত্ব নেওয়ার আগেই পাঁচ হাজার ৫০৬টি ডাকঘরকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আর প্রতিমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই সাড়ে আট হাজার ডাকঘরকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

একটি ভালো উদ্যোগে কলঙ্কের দাগ

প্রকল্পটি নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠলে গত বছরের ৭ অক্টোবর এবং চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় থেকে ‍দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি করা হয়।

প্রথম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মুসলেহ উদ্দিন ও দ্বিতীয়টির অতিরিক্ত সচিব (টেলিকম) মো. মুহিবুর রহমান।

দুটি কমিটিই তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, প্রকল্পের আওতায় সংগৃহীত যন্ত্রপাতির কোনোটিই ব্যবহারের কোনো প্রমাণ তারা পাননি। এমনকি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সংগৃহীত যন্ত্রপাতি কী কাজে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নির্দেশনা পর্যন্ত দেয়নি।

গত বছরের নভেম্বর ও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেওয়া দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, প্রকল্পে প্রশিক্ষণের জন্য ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও কাউকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি।

দুটি কমিটিই বলছে, প্রায় ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এই প্রকল্পটিতে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৩৮০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ১৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিষয়ে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদনে (পিসিআর) উল্লেখ করা হয়নি।

এই আর্থিক অনিয়মের পেছনে তারা দায়ী করেছেন ডাক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্রকে (এসএস ভদ্র)। তিনি প্রকল্পটিতে ২০১৪ সাল থেকে পরিচালক (পিডি) হিসেবে ছিলেন।

পরবর্তীতে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সুধাংশু শেখর ভদ্রের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ এসেছে। সবগুলো বিষয় নিয়েই তদন্ত চলছে। তাকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, নতুন করে বলার কিছু নেই।’

এমনকি মহাপরিচালককে অপসারণের জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সুপারিশও করেছে।

সংসদীয় কমিটির প্রধান বেনজীর আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি তার (মহাপরিচালক) দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অপসারণের সুপারিশ করেছে। আশা করছি এই সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এক শ্রেণির অসাধু সরকারি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের অংশগ্রহণে রাজনৈতিক সংশ্লেষকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে জনগণের অর্থ লোপাট হয়, ডাক বিভাগের ডিজির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটি তার একটি উদাহরণ।’

তিনি বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ও তার সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেসব পোস্ট ই-সেন্টার তৈরিই হয়নি, তার ঘোষণা দিয়ে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। উপরের মহলের যোগসাজশ না থাকলে এমন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি করা সম্ভব নয়।’

‘এটা দুদকের জন্য আশার কথা যে, সংসদীয় কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এখন এর পেছনে সত্যিকার অর্থেই যারা যারা জড়িত, দুদককেই তাদের খুঁজে বের করতে হবে’, যোগ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

কমিটি কী বলেছে

প্রথম তদন্ত কমিটির গত নভেম্বরে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় পোস্টাল ক্যাশ কার্ডধারী গ্রাহকদের সেবা দিতে পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন কেনা হয় ১৭ হাজার। কিন্তু, মেশিনগুলোর মধ্যে মাত্র ৭০৪টি ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ পিওএস মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে না।

আর ১০ হাজার ফিঙ্গার ভেইন মেশিন কেনা হলেও মাত্র ৬৪৩টি ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ ফিঙ্গার ভেইন মেশিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এ দুটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৫৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ও ১৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৭ হাজার পিওএস মেশিনের মধ্যে ১৪ হাজার ১২৯টি মেশিন মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি দুই হাজার ৮৭১টি মেশিন ডাক মহাপরিচালকের দপ্তরে পড়ে আছে। মাঠপর্যায়ে পাঠানো মেশিনগুলো অব্যবহৃত ও অবিতরণকৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

তদন্তকালে ডাক বিভাগের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে ৮৫০টি পিওএস মেশিন ও ৬০০টি ফিঙ্গার ভেইন মেশিন প্যাকেটবন্দি অবস্থায় পাওয়া গেছে।

ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে দ্বিতীয় কমিটি বলেছে, প্রকল্পের আওতায় ৫০০টি সাধারণ সার্ভার (ইউপিও) কেনা হলেও ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত তিনটি ভারী সার্ভার কেনা হয়নি। সাধারণ সার্ভারগুলোরও অনেকগুলো প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পরে সরবরাহ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে সুধাংশু শেখরের মুঠোফোনে বারবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। তার কার্যালয়ে গেলে ব্যক্তিগত সহকারী জানান, তিনি বেশ কিছুদিন ধরে অফিসে আসছেন না, বাসা থেকেও কোনো দাপ্তরিক কাজ করছেন না।

‘স্যার রেস্ট করছেন’, বলেন সুধাংশু শেখরের ব্যক্তিগত সহকারী।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সুধাংশু শেখর এখন তার পদে নেই।’

যদিও ওয়েবসাইটে মহাপরিচালক হিসেবে তার ছবি ও পরিচিতি রয়েছে।

মোস্তফা জব্বার বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও দুদকের প্রতিবেদনগুলো আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তাকে বরখাস্ত করা হবে না অন্য কোনো শাস্তি হবে, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই নির্ধারণ করবে।’

Comments

The Daily Star  | English
Prof Muhammad Yunus on Bangladesh India relations

Dhaka-Delhi ties should be based on equity: Prof Yunus

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus today said they need to maintain good relations with India but that should be based on equity and fairness

2h ago