‘অপরাধ’ নামের মিল, ৮০ বছরের হাবিবুর রহমান জেলে
শুধু নামের মিল থাকায় ৮০ বছর বয়সী এক নিরপরাধী বৃদ্ধকে জেলে পাঠিয়েছে পুলিশ। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা শহরের কলেজ রোডস্থ বনানী এলাকার ওই বৃদ্ধকে গত ৪ অক্টোবর একটি চেক ডিজঅনার মামলায় জেলে পাঠানো হয়।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের দায়েরকৃত ওই মামলায় ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ পটুয়াখালীর যুগ্ম জেলা দায়রা জজ আদালত আসামির এক বছরের কারাদণ্ড ও দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের নির্দেশ দেন।
মামলার নথি থেকে জানা গেছে, গলাচিপা পৌর শহরের মুজিব নগর রোডের নূর মোহাম্মাদ মাস্টারের ছেলে ও গলাচিপা থানা সংলগ্ন সদর রোডের নাহার গার্মেন্টসের মালিক মো. হাবিবুর রহমান ২০১২ সালের ৬ আগস্ট ব্র্যাক থেকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এক লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সে সময় তিনি ব্র্যাকের অনুকূলে উত্তরা ব্যাংক গলাচিপা শাখায় তার নিজস্ব অ্যাকাউন্টের (হিসাব নম্বর ২২০০) ঋণের সমপরিমাণ অর্থের একটি চেক জমা দেন। কিন্তু, তিনি ওই ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ হাবিবুর রহমানের জমাকৃত চেকটি ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল ওই ব্যাংকে জমা দিলে তাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ডিজঅনার হয়।
পরে ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালের ২ মে তাকে একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠায়। কিন্তু, তিনি ব্র্যাক থেকে ঋণ নেননি মর্মে ওই বছরের ১৬ জুন লিখিতভাবে ব্র্যাক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে তারা ঋণগ্রহীতা হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পটুয়াখালীর যুগ্ম দায়রা জজ জিন্নাৎ জাহান ঝুনু ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ রায় দেন। রায়ে হাবিবুর রহমানকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ঋণের দ্বিগুণ অর্থ, অর্থাৎ দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা দণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের দিন ঋণগ্রহীতা হাবিবুর রহমান আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
ওই পরোয়ানা অনুযায়ী গলাচিপা থানার সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) আল-আমিন শুধুমাত্র নামের মিল থাকায় গলাচিপা বনানী এলাকার ৭০ বছরের বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানকে ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর দুপুরে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে এবং ওই দিনই তাকে পটুয়াখালী কারাগারে পাঠায়। কারাগারে পাঠানো হাবিবুর রহমানের পিতার নাম নূর মোহাম্মাদ পন্ডিত।
এদিকে প্রকৃত ঋণগ্রহীতা হাবিবুর রহমান প্রায় পাঁচ বছর আগে গলাচিপা থানা সংলগ্ন সদর রোড থেকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুটিয়ে মহিলা কলেজ সড়কে নতুন করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি ব্যবসার ধরন পাল্টে এখন মুদি-মনোহরির ব্যবসা করছেন।
এ বিষয়ে কারাগারে পাঠানো হাবিবুর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার স্বামী কোনোদিন ব্যবসা করেননি। আর আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও নেইনি। আমাদের দুই ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে এবং আমাদের ভরণ-পোষণের জন্য প্রতি মাসে যে টাকা দেয়, তা দিয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী এখানে বসবাস করি। পুলিশকে বিষয়টি বলেছি। কিন্তু, তারা শোনেনি।’
গলাচিপা পৌরসভার কাউন্সিলর মো. শাহিন মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘খবরটি জানার পর আমি থানায় গিয়েছি এবং পুলিশকে বিষয়টি বলেছি। কিন্তু, আমি থানায় যাওয়ার আগেই তারা ওই বৃদ্ধকে পটুয়াখালী কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে।’
নিরপরাধ বৃদ্ধ হাবিবুর রহমানের ছোট ছেলে আবু সালেহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার বাবাকে কারাগারে পাঠানোর সংবাদ পেয়ে আমি ঢাকা থেকে চলে আসি এবং কাগজপত্র উঠানোর পর দেখি আমার নিরপরাধী বাবাকে পুলিশ শুধুমাত্র নামের মিল থাকার কারণে সাজাপ্রাপ্ত অন্য লোকের পরিবর্তে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।’
‘আমার বাবা অসুস্থ, চোখে ভাল দেখতে পান না, কানেও ভালো শুনতে পান না এবং চলাচলের তেমন শক্তিও নেই। এমনকি তিনি বাসার পাশে মসজিদে গিয়েও নামাজ আদায় করতে পারেন না। আমার বাবাকে এবং আমাদের পরিবারকে এভাবে অহেতুক হয়রানি ও সামাজিকভাবে হেয় করার ঘটনার সুবিচার চাই’, বলেন তিনি।
এ বিষয়ে গলাচিপা থানার এএসআই আল-আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আদালত থেকে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠাই। কিন্তু, পরে জানতে পারি তিনি প্রকৃত আসামি নন। বিষয়টি দুঃখজনক এবং আমার ভুল হয়েছে। তবে, নিরপরাধী ওই বৃদ্ধকে জেল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি।’
গলাচিপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আসামির নাম ও পিতার নামে মিল থাকায় সরল বিশ্বাসে এএসআই আল-আমিন তাকে গ্রেপ্তার করে। বিষয়টি আমরা সংশোধন করে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠিয়েছি এবং ওই বৃদ্ধকে দ্রুত কারামুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
Comments