‘দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে সারাদেশের নারীরা পরাজিত হবে’

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

নোয়াখালীতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে দেখা করেছেন লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদসহ ছয় জনের একটি নারী প্রতিনিধি দল।

ওই নারী, এলাকাবাসী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে আজ শনিবার তারা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গতকাল শুক্রবার লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদের সমন্বয়ে আমরা ছয় জন ঢাকা থেকে নোয়াখালী সদর ও বেগমগঞ্জে যাই। বেগমগঞ্জের নারী ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদের অংশ হিসাবে এবং ওই নারীর প্রতি গভীর সমবেদনা ও জোরালো সংহতি প্রকাশ করতেই আমাদের এই সফর।

উল্লেখ্য, ৩২ দিন আগে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে একজন ৩৭ বছর বয়সী নারীকে গণধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় এবং ‘দেলোয়ার বাহিনী’ নামে পরিচিত ধর্ষক ও নির্যাতকরা এই ঘটনার ভিডিওধারণ করেন। দেলোয়ার বাহিনী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এলাকায় ত্রাস ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে জানা যায়। ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হলে বিশেষভাবে নারীরা এবং একইসঙ্গে দেশবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইতোমধ্যে, সন্ত্রাস ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী নিজে বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন।

দুপুর ২টায় নোয়াখালী জেলা প্রেসক্লাবে পৌঁছে আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালী জেলার সাংবাদিক, আইনজীবী, নারী ও মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং শিক্ষার্থীরা। আমাদের মধ্যকার স্বতঃস্ফূর্ত আলাপ এসব বিষয়কে ঘিরে হয়: দোষীদের শাস্তি, বেগমগঞ্জের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মিডিয়াকর্মীদের ভূমিকা, গণতান্ত্রিক জনসম্পৃক্ততার পরিবর্তে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরির সংস্কৃতি, বিচারহীনতা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর রাজনৈতিক নেতাদের ‘বিচার হবে’র আশ্বাস প্রদানের পরিবর্তে আমরা চাই এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যারা ধর্ষক তৈরি হওয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার বিরোধী এবং নির্যাতনের শিকার নারীর নিরাপত্তা ও বৃহত্তর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে আমরা এ বিষয়ে জোরারোপ করি যে, নোয়াখালী জেলার নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশাসনিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাহিনীর উপস্থিতি সংঘাতময়। মূল সমস্যার সম্মুখীন হওয়া একান্ত জরুরি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্যাতিত নারীর জন্য ঘর তুলে দেওয়া হবে জেনে আমরা জেলা প্রশাসককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি আমাদের অবহিত করেন, পুলিশ কীভাবে নির্যাতিত নারীকে সহায়তা করছে এবং তদন্ত ও মামলা বর্তমানে কোন পর্যায়ে। নির্যাতিত নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পাওয়ার পর আমরা সন্ধ্যা সাড়ে ৭ বেগমগঞ্জ থানায় যাই। এসময় আমাদের সঙ্গে নোয়াখালী জেলার বার কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম রসুল মামুন, মানবাধিকার কর্মী আব্দুল আওয়াল, ‘নিজেরা করি’র আয়েশা সিদ্দিকা লাকীসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। 

নির্যাতনের শিকার নারীর সঙ্গে দেখা হলে আমরা তাকে জানাই যে, এই লড়াই কেবল বেগমগঞ্জের কোনো এক নারীর বা নোয়াখালীর নয়, এটি সারাদেশের নারীর লড়াই, নারী নির্যাতন-বৈষম্যর বিরুদ্ধে থাকা সব সচেতন নাগরিকের লড়াই। বেগমগঞ্জের নারীর পাশে সারাদেশের ধর্ষণ নির্যাতন বিরোধীরা আছেন এবং থাকবেন। এই পরিস্থিতিতে কোনো ভয়ভীতি, হেনস্তার কাছে পরাস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি যে কোনোভাবেই একা নন, এ বিষয়ে আমরা তাকে বার বার আশ্বস্ত করি। তার সাহস ধর্ষণ ও ধর্ষণের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি জোগাবে এবং সঙ্গী হয়ে থাকবে।

নির্যাতিত নারী আমাদের কাছে তার ক্ষোভ-দুঃখ এবং দাবির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে শুধু বেগমগঞ্জ না সমগ্র দেশের নারীরা পরাজিত হবে। এই ঘটনার বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না। কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে ধনী, কে গরীব, কে শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত, এইসব বিবেচনার বাইরে আসতে হবে নারীদের। কেবল নারী হিসাবে নারীর ওপর যে বর্বর নির্যাতন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই এখন জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার বিচার না হলে মাথা উঁচু করে তিনি যেমন গ্রামে যেতে পারবেন না, তেমনি দেশের নারীরাও মাথা উঁচু করে চলতে পারবে না। কারণ ধর্ষক-নিপীড়করা শুধু তাকে নয়, সারাদেশের নারীদেরই বিবস্ত্র করেছে।’

নোয়াখালীতে এই ধরনের যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা কেন এতোদিন প্রকাশ পেল না, সেটি জরুরি প্রশ্ন। পত্র-পত্রিকা এবং এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে, ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যসহ সম্রাট বাহিনী, সুমন বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ত্রাস সৃষ্টি ও সন্ত্রাসী কাজ করে আসছিল। সুমন বাহিনীর হাত ধরেই দেলোয়ার বাহিনীর উত্থান। ক্ষমতাশীলদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারছে। এই আন্দোলন ধর্ষকের গ্রেপ্তার বা শাস্তির দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে বিচারের মুখ দেখবে না। এর জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাশীল শক্তির ছত্রছায়ায় থাকা নিপীড়ক-নির্যাতক বাহিনীর ক্ষমতার উৎসকেও প্রশ্ন করা ও তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা। দেলোয়ার বাহিনীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎসকে আড়াল করে নারীর জন্য নিরাপদ জীবন, নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

আমরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং থানার ওসিকে নির্যাতিত নারীর নিরাপত্তা প্রদানে সর্ব্বোচ্চ ভূমিকা রাখার বিষয়ে সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানাই। বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ এ যাবত নারীর ওপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।

বিবৃতি দিয়েছেন যারা:    লেখক-গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী বীথি ঘোষ, রাজনৈতিক কর্মী এবং আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মী মাহফুজা হক, উন্নয়নকর্মী শিপ্রা বোস এবং শ্রমিক ও নারী আন্দোলন সংগঠক এবং আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার।

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

6h ago