যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে ‘জৈব অস্ত্র’ পাঠাচ্ছে চীন?

চীন থেকে আসা একটি পার্সেলের প্যাকেট ও ভেতর থেকে পাওয়া বীজ। ছবি: এসসিএমপি

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য মানুষের বাড়িতে এক ধরনের পার্সেল পৌঁছে গেছে। পার্সেলের উপরের লেবেল থেকে জানা যায়, কোনো চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে এগুলো পাঠানো হয়েছে। অর্ডার না করা সত্ত্বেও বিভিন্ন জাতের বীজ সম্বলিত এই পার্সেল নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে চলমান উত্তেজনর মধ্যে কারা, কেন, কী উদ্দেশ্যে এই পার্সেলগুলো পাঠিয়েছে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবাই।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে।

নিউইয়র্কের ওয়ারউইকের পেঁয়াজ চাষি ক্রিস পাভেলস্কি গত জুলাই মাসে তার পোস্ট বক্সে একটি পার্সেল পান। সেটি তিনি অর্ডার করেননি। কৌতূহলী হয়ে তিনি পার্সেলটি উল্টেপাল্টে দেখেন। এর ওপর লাগানো শিপিং লেবেল থেকে বোঝা যায়, এটি দক্ষিণ চীনের প্রযুক্তি কেন্দ্র শেনজেন থেকে এসেছে।

৫৩ বছর বয়সী পাভেলস্কি পার্সেলটির ভেতরে অনেকগুলো বীজের একটি ছোট প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখতে পান।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে তিনিও একজন যিনি এই ধরনের বীজ পেয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বীজ কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, এগুলো কোনো প্র্যাংক বা দুষ্টুমির ফাঁদ হতে পারে। আবার চীনের পাঠানো কোনও জৈব অস্ত্রও হতে পারে।

এসব বিড়ম্বনার মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশি বিক্রেতাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বীজ বিক্রয় নিষিদ্ধ করে অ্যামাজন।

পাভেলস্কি জানান, পার্সেলটি তাকে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়। যা তার অনেক সহকর্মীকে কঠোরভাবে আঘাত করেছিল।

তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই, পুরো বাণিজ্য যুদ্ধ আমাকে তেমন প্রভাবিত করেনি। কিন্তু, আমি জানি চীনের সঙ্গে এখন এক ধরনের উত্তেজনা চলছে। এখানে কার কী উদ্দেশ্য তা আমাদের ধারণার বাইরে।’

পাভেলস্কি পার্সেলটি পাওয়া মাত্রই মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রাণী ও উদ্ভিদ স্বাস্থ্য পরিদর্শন ইউনিটকে ফোন করেন। কয়েক ঘণ্টা পর বীজগুলো ফেডারেল এজেন্সিতে পাঠান তিনি।

প্যাকেজগুলোর কারণে প্রাথমিকভাবে করোনা মহামারির সময়ে উদ্বেগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিলেও ই-বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, প্যাকেজগুলো সম্ভবত ‘ব্রাশিং’ এর জন্য পাঠানো হয়েছে।

অনলাইন বিক্রেতারা (অধিকাংশই চীনা উৎপাদন কেন্দ্র) কেনাকাটার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের পণ্যের র‌্যাঙ্কিং বাড়ানোর জন্য এক ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন, যাকে ‘ব্রাশিং’ বলা হয়।

প্যাকেজের ওপরে থাকা স্বল্প তথ্য থেকে জানা যায়, এগুলো স্পষ্টতই চীন থেকে পাঠানো হয়েছিল। কেবল যুক্তরাষ্ট্র না, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই ধরনের পার্সেল গিয়েছে এবং সে দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ওই বীজ রোপণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে।

পার্সেলগুলোর বেশ কিছু ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে পার্সেলের ওপরে ‘চায়না পোস্ট’ লেবেল দেখা যায় এবং শেনজেন, সুজহু ও পুটিয়ানসহ বেশ কয়েকটি চীনা শহর থেকে পোস্টমার্ক করা হয়েছে বলে জানা যায়।

কিছু শিপিং নম্বরে ট্র্যাকিং করার মতো কোনো তথ্য ছিল না।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের অনুসন্ধানে প্যাকেজের উপর থেকে ১৮টি বৈধ ট্র্যাকিং নম্বর শনাক্ত করা হয়।

জানা গেছে, জানুয়ারির শেষ থেকে জুলাই পর্যন্ত পার্সেলগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট শিপিং লেবেলে থাকা চীনা টেলিফোন নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করে।

শিউ নামে এক ব্যক্তি নিজেকে ‘চায়না পোস্টে’র কর্মচারী বলে পরিচয় দেন। তিনি সাংহাইয়ের বিদেশে মালপত্র পাঠানোর বিভাগটি পরিচালনা করেন বলেন জানান। কোনও বীজের প্যাকেজ সম্পর্কে তার ধারণা নেই বলেও যোগ করেন তিনি।

অপর একটি ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে শেনজেনের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তবে, তিনি নিজের পরিচয় দিতে রাজি হননি।

নিজেকে একটি ই-কমার্স স্টোরেজ সংস্থার মালিক বলে পরিচয় দিলেও তার নাম্বার কেন বীজের পার্সেলগুলোতে আছে তা তিনি জানেন না বলে জানান।

পার্সেল সম্পর্কে জানার পর তিনি বলেন, ‘সেখানে আমার ফোন নম্বর কেন আছে? আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। হায় ঈশ্বর! এর কারণে আমার কোনো সমস্যা হবে?’

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ফুজিয়ান প্রদেশের পুটিয়ানে বসবাসকারী আরেক ব্যক্তিও নিজের পরিচয় দিতে রাজি হননি। পার্সেলের বিষয়েও তিনি কোনো কথা বলেননি।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টি তদন্ত করছে। বেইজিং জানায়, ‘চায়না পোস্ট’ লেখা শিপিং লেবেলগুলো নকল ছিল। অন্যান্য দেশের ডাক কর্তৃপক্ষকে এ জাতীয় কোনও মিথ্যা প্যাকেজ আটকে দেওয়ার অনুরোধ করেছে বেইজিং।

গত আগস্টে ইউএসডিএ জানায়, তারা এমন কিছু সংস্থাকে শনাক্ত করেছে যারা এই বীজ পাঠানোর সঙ্গে জড়িত। তাদের তদন্তে চীনা কর্তৃপক্ষের সহায়তা প্রয়োজন।

এক অনলাইন বিবৃতিতে ইউএসডিএ বলছে, এটি একটি ‘ব্রাশ কেলেঙ্কারি’ ছাড়া অন্য কিছু কিনা সে সম্পর্কে আমাদের কাছে এখনও কোনও প্রমাণ নেই। ইউএসডিএ বর্তমানে প্রাপকদের কাছ থেকে বীজের পার্সেলগুলো সংগ্রহ করছে। বীজগুলো পরীক্ষা করে তারা নির্ধারণ করবে, সেগুলোতে মার্কিন কৃষি বা পরিবেশের জন্য উদ্বেগজনক কিছু আছে কিনা।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

প্রাণী ও উদ্ভিদ স্বাস্থ্য পরিদর্শন বিভাগ জানায়, এই ধরনের পার্সেলে সরিষা বীজ, মর্নিং গ্লোরি, বাঁধাকপি, পুদিনা, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার ও গোলাপসহ কমপক্ষে ১৪ ধরনের বীজ আছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মোট কতগুলো পার্সেল পাঠানো হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট না। তবে লুইসিয়ানার কৃষি ও বন বিভাগ জানায়, প্রায় ১৬ হাজার নমুনাসহ রাজ্যটিতে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বীজ পাঠানো হয়েছে।

বিভাগটি আরও জানায়, ইউএসডিএ কমপক্ষে ৪৪টি দেশকে শনাক্ত করেছে যেখান থেকে এগুলো আসতে পারে।

কেন বীজ সরবরাহ করা হয়েছিল? এ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারিসহ চীনের ‘আগ্রাসন’ নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

টুইটার এবং রেডইডে অনেকেই কৌতুক করে, ওই বীজ থেকে দৈত্য বের হবে বা বীজ থেকে করোনাভাইরাস ছড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন।

ব্রাশিং স্কিম

চীনা ব্যবসায়ীরা, যারা বিশ্ব জুড়ে কেনাকাটার সাইটগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তারা মূলত ব্রাশিং কৌশলের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদমগুলোকে প্রভাবিত করেন। এর ফলে, অনেক বেশি বিক্রি ও পজিটিভ রিভিউয়ের কারণে তাদের পণ্য র‌্যাঙ্কিংয়ে ওপরের দিকে থাকে।

ব্রাশাররা তাদের নিজস্ব নকল শপিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্য অর্ডার দেয়। তারপর তারা তাদের নিজস্ব বিদেশের ঠিকানায় পার্সেল পাঠায়। পার্সেলগুলোতে ওই পণ্য থাকতে পারে কিংবা অন্য কোনো সস্তা পণ্যও থাকতে পারে। এমনকি খালি প্যাকেটও থাকতে পারে।

কিন্তু, এই ধরনের পার্সেল বিতরণ কেনাকাটার সাইটগুলোতে তাদের অর্ডারগুলোকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ব্রাশাররা সাইটে বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে পজিটিভ রিভিউ পোস্ট করতে থাকে। এই ধরনের পার্সেলগুলো সবচেয়ে বেশি চীন থেকেই আসে।

সাম্প্রতিক সময়ে অর্ডার ছাড়াই খেলনা, সানগ্লাস থেকে শুরু করে গহনা, মাস্কসহ বিভিন্ন পণ্য হাতে পেয়েছেন এমন অনেক ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া গেছে। ব্রাশাররা কীভাবে তাদের নাম ও ঠিকানা পেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়।

পাভেলস্কি জানান, তিনি একবার ইবেতে চীনা কোম্পানির কাছ থেকে তার স্ত্রীর জন্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য অর্ডার করেছিলেন। সেসময় তার বাসার ঠিকানা ও তথ্য দিয়েছিলেন।

চীনা কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে ব্রাশিংয়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। দেশটিতে গত বছর প্রণয়ন করা ‘ই-বাণিজ্য আইন’। যা ব্রাশিংকে ভুয়া লেনদেন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে এবং অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে।

তবুও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে চীনা ব্যবসায়ীদের ব্রাশিং কৌশল বিস্তৃত।

চেন নামের এক শেনজেন-ভিত্তিক ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রেতা জানান, তিনি নিয়মিত ব্রাশিং এজেন্টদের নিয়োগ দেন। যাতে অ্যামাজনে তার পণ্যের র‌্যাঙ্কিং ওপরের দিকে থাকে।

তিনি বলেন, ‘অ্যামাজনে একটি দোকান চালাতে অনেক টাকা লাগে। ব্রাশ না করে লাভ করা যায় না।’

তবে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো বীজের প্যাকেজগুলো ব্রাশিং কৌশলের অংশ, নাকি কোনও ষড়যন্ত্র এই নিয়ে এখনো জল্পনা কল্পনা চলছে।

Comments

The Daily Star  | English

JnU protests called off

Students and teachers of Jagannath University called off their protest last night after receiving assurances from the government that their demands would be met.

6h ago