সমাজের বেড়াজাল ভেঙে মধ্যরাতে নারীদের ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’

‘দিনে হোক রাতে হোক, সামলিয়ে রাখো চোখ’
শাহবাগ থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ অভিমুখে যাচ্ছে মিছিল। ছবি: আমরান হোসেন

সারাদেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ থেকে মশাল হাতে পদযাত্রা করে মানিক মিয়া এভিনিউ অভিমুখে যান একদল শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে যোগ দেন শিক্ষক, অভিভাবকসহ  বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মঙ্গলবার রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ শীর্ষক ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগ থেকে মিছিলটি শুরু হয়। কাটাবন, সাইন্সল্যাব, রাপা প্লাজা হয়ে মিছিলটি মানিক মিয়া এভিনিউতে পৌঁছায় রাত দেড়টার দিকে।

শাহবাগ থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ অভিমুখে মিছিলের একাংশ। ছবি: আমরান হোসেন

অপরাধীদের ন্যায্য শাস্তি, ধর্ষণের সংজ্ঞায়নের সংস্কার, পাহাড় ও সমতলের সকল নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভুক্তভোগীকে হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার, দেশের সব প্রতিষ্ঠানে নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর, শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ৯০ দিনের মধ্যে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচার, গণপরিবহনে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ধর্মীয় বক্তব্যের নামে নারীদের প্রতি অবমাননা বন্ধ এবং হটলাইন সুবিধা চালু করার দাবি জানান তারা।

শাহবাগ থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ অভিমুখে মিছিলের একাংশ। ছবি: আমরান হোসেন

রাত ১২টায় মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ফাইজা ফাইরুজ রিমঝিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সন্ধ্যায় কিংবা দিনে কোনো মেয়ে বাইরে বের হয়ে নিপীড়নের শিকার হলে তখন একটা অযুহাত ওঠে যে সে কেন সন্ধ্যায় বের হয়েছে। তাকে দোষারোপ করা হয় যে তার চরিত্রে সমস্যা। অলিখিতভাবে মেয়েদের রাতে বের হওয়াটা যেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দিনেও মানুষের কাজ থাকতে পারে, রাতেও কাজ থাকতে পারে। এই যে মেয়েদের রাতে বের হওয়ার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা তার বিরোধ করতেই আমরা রাতে মিছিল করেছি।’

মিছিল শেষে মানিক মিয়া এভিনিউতে বসে নিজেদের দাবি তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা। ছবি: সুচিস্মিতা তিথি

আরেক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সারাফ বলেন, ‘আমাদের প্রতিটা পদে পদে বাধা পেতে হয়৷ একটা মেয়ে সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারবে না। কিন্তু কেন? একটা ছেলে সন্ধ্যার পরেও মিছিলে যেতে পারে। তাদের বাবা-মা সেভাবে আপত্তি তোলেন না। আমার বাবা-মা আজকে এখানে আমার সঙ্গে এসেছেন শুধু আমার নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এটা কেন হবে? আমরা তো স্বাধীন দেশের নাগরিক।’

আন্দোলনকারীরা মিছিলে ‘দিনে হোক রাতে হোক, সামলিয়ে রাখো চোখ’, ‘আমি নির্দোষ আমি নারী, আসল দোষী ধর্ষণকারী’, ‘আমার বোন কবরে ধর্ষক কেন বাইরে’ স্লোগান দেন।

নারীদের এই আন্দোলনে অনেক পুরুষ কর্মীরাও সংহতি জানান। আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ড. শহীদুল আলম, রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফাসহ আরও অনেক বিশিষ্টজন।

সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে আন্দোলনকারীরা ১২ দফা দাবি জানান। এর মধ্যে রয়েছে-

  • আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনে ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন সংস্কার করতে হবে।
  • পাহাড় ও সমতলের সব নারীর উপর সামরিক ও বেসামরিক সকল প্রকার যৌন এবং সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে।
  • জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ (দোষারোপ করা বা নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
  • প্রাথমিক থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ, ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কন্সেন্টের গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে অবহিত করা) যুক্ত করতে হবে।
  • ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ করতে হবে এবং মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।
  • হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
  • সিডও সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে।

রাত আড়াইটার দিকে সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশটি শেষ হয়।

Comments

The Daily Star  | English

July charter implementation: What notes of dissent could mean

The July National Charter, finalised after weeks of consensus talks, faces a delicate challenge over notes of dissent, most of them from the BNP and its allies.

15h ago