বৈচিত্র্যময় দিল্লি
ঢাকা থেকে দিল্লির দূরত্ব এক হাজার ৮৭৩ কিলোমিটার। ট্রেনে গেলে লাগে দুই দিন। আর ফ্লাইটে দুই ঘণ্টা। দুই শহরের সময়ের ব্যবধান আধঘণ্টার, আমার আম্মার চিরাচরিত আদেশ, ‘পৌঁছায় কল দিস’। আম্মা ভয়ে থাকে এই শহর নিয়ে। খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেলগুলোতে ভেসে বেড়ানো বীভৎসতা, বিশেষ করে নারীর ওপর হওয়া সহিংসতা আম্মার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দেয়। আমি তাই অভয় দিতে সময় পেলেই দিল্লির রাস্তাঘাটের ছবি তুলে, ছোট ছোট ঘটনার কথা লিখে পাঠাই। একটা শহর তো একটা বইয়ের মতো, তাকে কী এতো সহজে পড়ে ফেলা যায়?
এই শহর অসংগতির শহর। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা থাকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে আদ্রতা না থাকায় শরীরে ঘাম হয় না। বাইরে বের হলে লু হাওয়া স্বাগত জানায়। আমার বাঙালি মন গরম বেশি পরলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ খোঁজে। সহস্রবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ গোনার পর আমি বুঝতে পারি আর যাই হোক এই শহরে মেঘ ভাসে না! তবে একবার দুবার ভুল করে বৃষ্টি হলেও তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঢাকায় টানা দুই দিন বৃষ্টিপাতের কথা আমি দিল্লিবাসীদের শুনিয়েছি, তারা মিটমিট করে হাসে, বুঝি ভাবে আমার মাথা খারাপ।
দিল্লি আমাকে এবং আমার মতো মানুষদের কভিডের আগেই মুখে মাস্ক পরানো শিখিয়েছে। বাতাসে দূষণমাত্রা এতো বেশি থাকে যে মাস্ক পরতেই হয়। পরে শুনেছি, দিল্লিতে যথেষ্ট সবুজ থাকলেও এই সময়ে পাশের দুই স্টেটে চাষাবাদের জন্য আগুন জ্বালানো হয় (স্টাবল বারনিং)। সেই আগুনের ধোঁয়ায় দিল্লি দৃশ্যমান থাকে না বেশ কিছুদিন! আবার ডিসেম্বর মাস আসতে আসতেই তাপমাত্রা কমে ২ ডিগ্রির কাছে চলে আসে। এই সময়টায় শৌখিন মানুষ পরিবার নিয়ে উত্তরের সিমলা- মানালি ঘুরতে যায়, তুষারপাত দেখার জন্য।
৭০০ বছরের পুরনো এই শহরের আয়তনও বিশাল। দিল্লির আবাস বাড়তে বাড়তে দুই পাশের দুই রাজ্যে গিয়ে পড়েছে। একদিকে উত্তর প্রদেশে নয়ডা আরেকদিকে হারিয়ানা রাজ্যের গুরুগ্রাম – এই দুটো এলাকাকে এন সি আর (ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিওন) বলা হয়। এখানকার আবাসিক এলাকাগুলো একেবারেই নতুন আর ভীষণ গোছানো। উঁচু উঁচু দালানের আড়ালে আকাশ লুকিয়ে থাকে। করপোরেটস হাউস আর এজেন্সির দাপট চলে সর্বত্র। আর হাউজিং সোসাইটিগুলো যেন একেকটা আলাদা পৃথিবী। সোসাইটির বাসিন্দারা সোসাইটির নিজস্ব অ্যাপ ব্যবহার করে। তাদের বাড়িতে কে এলো, সে ঘরে কাজের সহকর্মী ছিল নাকি মালিক ছিল সবই ওই অ্যাপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়। সোসাইটির ভেতরেই জিম, সুইমিং পুল, শপিং এর যায়গা –সব। এই ছোট্ট জায়গার ভেতরেই সোসাইটির বাসিন্দারা দীপাবলি, দুর্গাপূজা অথবা মেলার আয়োজন করে। সকাল সকাল বয়স্করা হাঁটতে বের হন পোষা কুকুর নিয়ে। স্কুল বাস থামে গেটের সামনে, বাচ্চারা বাবা-মার সাথে বের হয়ে যায়। সকাল-বিকাল একই ছবি।
প্রথম প্রথম এই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেশ যুতসই লাগে, কিন্তু যান্ত্রিক শহরেরও একটা প্রাণ থাকে। রূপকথার ভোমরার মতো শহরের প্রাণ গচ্ছিত থাকে তার শত-সহস্র বছরের পুরনো ঐতিহ্যে, মানুষের ভিড়ে, জরাজীর্ণ দালানে আর মুখরোচক খাবারে। এনসিআর থেকে তাই দিল্লীর দিকে আসতেই হয় আমাদের ।
দিল্লির নিত্য নতুন খোলসে আর তার বাসিন্দাদের হুটোপুটিতে আমার প্রথমদিকে বেশ গলা শুকাতো। তা থেকে রেহাই পেতে মেট্রোরেলে চড়ে দিল্লি চষে বেড়ান একটা নেশা হয়ে দাঁড়াল। ঢাকায় যে মেট্রো রেল ছোট গল্পের মত ‘হইয়াও হইল না শেষ’ অবস্থায় আছে, সেখানে দিল্লিমেট্রো শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দাপটের সাথে নিয়ে যায়। আমি নীল লাইনে চড়ে উত্তর প্রদেশ থেকে হরিয়ানা যাই। আগেই বলেছি এই দুই শহর নতুন নতুন দিল্লির সাথে যুক্ত হয়েছে। মেট্রোর হলুদ লাইনে চড়ে যাওয়া যায় ল্যুটন দিল্লি। ব্রিটিশ সাহেব এডওয়ার্ড ল্যুটন এর নামে নামকরণ। উনি পেশায় আর্কিটেক্ট ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে রাজধানী কলকাতা থেকে ফের দিল্লি করার সময়কালে ল্যুটন দিল্লির ডিজাইন ও নির্মাণ হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এখানে থাকেন।
মেট্রোর ভায়োলেট লাইনে চড়ে যাওয়া যায় বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে। ইলিশ মাছ থেকে শুরু করে কাসুন্দি সব পাওয়া যায় এখানে। আবার দরদামটাও বাংলায় করা যায়। সাধারণ টুরিস্টদের ভ্রমণ তালিকায় এখনও চাঁদনীচকের শাড়ি আর জামে মসজিদই এক নম্বরে আর আমরা যারা স্বদেশের ঘর খুঁজে মরি তাদের কিন্তু বেশ লাগে দিল্লিতে থেকে মাঝে মাঝে নিজের ভাষায় কথা বলতে পেরে।
এই ভায়োলেট লাইনেই পরে আমার ক্যাম্পাস, কাশ্মীরি গেট। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের হাতে গড়া শহর শাহজাহানপুরের মাঝে। সকালে ক্লাস থাকলে মেট্রো থেকে নেমে অটো নিয়ে জাহান আরা বেগমের চাঁদনি চক চলে যাই। চকের মুখেই আলু-সবজি আর লাসসি পাওয়া যায়। হাতে সময় থাকলে ৩৬৪ বছরের জামে মসজিদের সামনে নিহারি খাওয়া যায়।
ক্লাস শেষ করে সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় পুত্র দারাশিকোর ব্যক্তিগত লাইব্রেরির সামনে বসে খানিক আড্ডা দেওয়া। ভাই আওরঙ্গজেবের হাতে খুন হওয়া দারাশিকোর লাশের মতো তার গ্রন্থাগারটিও অবহেলায় পড়ে আছে। দালানটা কোনমতে টিকে আছে শুধু। ক্যাম্পাসের বাইরেও ঘুরতে যাওয়ার কমতি নেই। একটু হাঁটলেই লাল কিলা বা রেড ফোর্ট। উল্টো পাশে চাঁদনীচকের ভেতর সিস গাঞ্জ সাহেবের গুরুদুয়ার। একবার এমনিতেই ঘুরতে ঘুরতে মির্জা গালিবের ঘরের সামনে চলে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা ছিল, তাই আর ভেতরে যাওয়া হয়নি।
এই ঘুরাঘুরির অভ্যাসের কারণে মাসের শেষে খরচে টান পড়ে। স্টাইপেন্ড কবে আসবে জিজ্ঞেস করে যখন কান ঝালাপালা করছিলাম তখন এক বান্ধবী দিনের বেলায় বাসে চলাফেরা করতে পরামর্শ দিলো। রাতে এখনও মেট্রোকে সবচেয়ে নিরাপদ ধরা হয়। এখানে মেয়েদের জন্য বাসের টিকেট ফ্রি, তাই বেশ কিছু রুপি বেঁচে যায়। বাসা ভাড়া করতে গিয়ে শুনি বিদ্যুৎ ভাড়াও ২০০ ইউনিটের চেয়ে কম হলে দিতে হয় না। বাহ ! তবে সবচে বেশি আনন্দ পেয়েছি ফ্রি তে কাঁচামরিচ আর ধনিয়াপাতা পেয়ে। সাউথ দিল্লিতে আমাদের বাড়ির সামনে, বিকেলে ভ্যানে করে সবজি বেচা হয়। হাটবারে বেশি ভ্যান থাকে আর অন্য দিনে হাতেগোনা স্থানীয় কয়েকটা। সবজি কেনার পর তাদের বললেই একমুঠো ধনিয়া পাতা আর মরিচ দিয়ে দেয়। সব সবজিওয়ালাই তাই করে। আহা অন্য শহরে এমনটা দেয় কিনা জানি না! কাঠখোট্টা এই শহরে সবজিওয়ালার এই একটুখানি মমতা আমার বড্ড ভালো লাগে।
(লেখক: কুররাতুল আয়েন সুধা, এমফিল স্কলার, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস, ড. বি আর আমবেডকার বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি)
Comments