নিউজিল্যান্ড: নির্বাচন নিয়েও যেখানে শোরগোল হয় না
শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ড নিয়ে বহির্বিশ্বে তেমন একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মোকাবিলায় দেশটি যে সফলতা দেখিয়েছে তা প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। নিউজিল্যান্ডই বোধহয় বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে সবকিছু চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। সেই নিউজিল্যান্ডেই আগামীকাল ১৭ অক্টোবর হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন।
নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় সবার আগে আসে ভোটাধিকারের কথা। হ্যাঁ, দেশটিতে সব নাগরিক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিঃসংকোচে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। একটি কথা এখানে উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশটি। কারণ নিউজিল্যান্ডই বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল ১৮৯৩ সালে।
নিউজিল্যান্ডের পদাংক অনুসরণ করে ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে। ব্রিটেনের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯১৮ সালে, আমেরিকায় ১৯২০ সালে। আর অবিভক্ত বাংলার নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯৩৫ সালে। আর সবশেষে ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নারীরা প্রথমবারের মতো পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।
নির্বাচনের একটি মূল অনুষঙ্গ প্রচার-প্রচারণা। শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ডে নির্বাচন উপলক্ষে কোনো মিছিল, মিটিং, মাইকিং, স্লোগান এসব কিছুই হয় না। শুধু টেলিভিশন, খবরের কাগজে কিছু আলোচনা, বিতর্ক আর রাস্তার কোথাও কোথাও থাকে প্রার্থীদের প্ল্যাকার্ড। সাধারণ প্রার্থী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সব প্রার্থীই নিজের হাতে সীমিত আকারে লিফলেট বিতরণ করেন। নির্বাচনী সমাবেশ দু'একটি হলেও তা হয় নির্দিষ্ট কোনো জায়গায়, কারো কোনো কষ্টের উদ্রেক না করে।
এবার আসি নিউজিল্যান্ডের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। শান্ত নিরিবিলি এই দেশটির জাতীয় নির্বাচনে সবাই দুটি করে ভোট দিতে পারে। এর মধ্যে একটা প্রার্থীর জন্য, অন্যটা দলের জন্য। কারণ দলের জন্য যে ভোট আপনি দেবেন তার মাধ্যমেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। নিউজিল্যান্ড সংসদে আসন সংখ্যা ১২০টি। তারমধ্যে ৭২টি আসন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয় এবং বাকি ৪৮টি আসন নির্বাচিত হয় দল কত শতাংশ ভোট পেলো তার ভিত্তিতে।
এ নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে একজন ভোটার তার ভোটাধিকার স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারেন। যেমন ধরুন, আপনার এলাকায় আপনি যাকে ভোট দিতে চাইছেন, তিনি আপনার পছন্দের দলের প্রার্থী নয়। সেক্ষেত্রে আপনি একই সঙ্গে পছন্দের প্রার্থী এবং পছন্দের দলকে ভোট দিতে পারবেন। আর আগেই বলেছি, দলের জন্য দেয়া ভোটের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় কোন দলের মোট ক'জন সংসদ সদস্য থাকবে।
২০২০ জাতীয় নির্বাচনে নিউজিল্যান্ডে আগাম ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে ৩ অক্টোবর থেকে। নিউজিল্যান্ডের নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দেশটিতে আগাম ভোট দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে আগাম ভোট পড়েছিল ৪৭ শতাংশ। যা চলতি নির্বাচনে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
আগাম ভোট গ্রহণের জন্য নিউজিল্যান্ড জুড়ে ৪৫০টি ‘অগ্রিম ভোট কেন্দ্র’ খোলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পড়াশোনার কারণে এখন অবস্থান করতে হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের পামারস্টোন নর্থ শহরে। এই শহরে কোনো নির্বাচনী পোস্টার কিংবা মিছিল চোখে পড়েনি। এমনকি গত ১৭ সেপ্টেম্বর নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডর্ন আমার মেসি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস পরিদর্শনে এলেও আমিসহ অনেকেই ওইদিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত থেকেও জানতে পারিনি। পরে মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন আমার ক্যাম্পাসে।
আজ গিয়েছিলাম আমার ক্যাম্পাসের একটি ভোটকেন্দ্র দেখতে। বাংলাদেশে কোন নির্বাচন কেন্দ্রের আশেপাশে গেলেই বোঝা যায় ভোট চলছে। পুরো এলাকায় সাজসাজ রব পড়ে যায়। চলে উত্তেজনা। আর এখানে দেখা গেল কোনো ভিড় নেই শুধু বাইরে একটি সাইন বোর্ড ঝুলছে যাতে লেখা “VOTE HERE” অর্থাৎ "এখানে ভোট গ্রহণ করা হয়"। এর বাইরে কোন কিছু দেখে বোঝা কঠিন এখানে নির্বাচন চলছে।
লেখক: মু. মাহবুবুর রহমান, নিউজিল্যান্ডের মেসি ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক
Comments