টাকা দিয়ে যেন কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে না পারে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে ঘুষ দুর্নীতি এবং চালকের মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিআইডি ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে ঘুষ দুর্নীতি এবং চালকের মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।

একইসঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটলেই আইন হাতে তুলে নেওয়ার মানসিকতা পরিহার এবং সকলের ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বানও পুণর্ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সময় ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেন, ভালমতো সে ড্রাইভিংটা জানে কি না বা টাকা দিয়ে যেন কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দেয়া নির্দেশে বলেন, ‘আপনাদের আরেকটা বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে, যারা গাড়ি চালাচ্ছে তারা মাদক সেবন করছে কি না। ডোপ টেস্ট বা মাদক সেবনের বিষয়ে পরীক্ষা করা দরকার। প্রতিটি ড্রাইভারের এই পরীক্ষাটা একান্তভাবে অপরিহার্য।’

তিনি আরো বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঘটলেই চালককে সব দোষ দিয়ে তাকে প্রহার করা বা প্রহার করতে করতে মেরে ফেলার মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার যে সংস্কৃতি দেশে রয়েছে তা সবাইকে ত্যাগ করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী আজ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২০ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বলেন, ‘দেশে ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন।’

‘আমাদের পথচারীদের মধ্যে নাগরিক সচেতনতার খুব অভাব রয়েছে। আমরা মুখে খুব বলে যাই কিন্তু কাজের বেলায় দেখি পাশেই ফুটওভার ব্রিজ অথচ রাস্তার মধ্যখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটা গাড়ি আসছে অথচ হাত দেখিয়েই অমনি হাঁটা দিলো কিংবা বাবা দেখা যাচ্ছে বাচ্চা কোলে নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তার বেড়া দেওয়া ডিভাইডার অবৈধভাবে অতিক্রম করছে।

তিনি বলেন, গাড়িটা একটা যন্ত্র কাজেই ব্রেক করলেও থামতে একটু সময় লেগে যায়। হাত দেখালেই থেমে যেতে পারে না।’

এই বিষয়েও মানুষ, চালকসহ সকলকে সচেতন করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ প্রদান করেন।

তিনি উদাহরণ দেন-ব্যক্তির নিজের ভুলে সে দুর্ঘটনার শিকার হলেও অনেক সময় অহেতুক চালককে, সরকারকে বা সড়ককে দোষ দেওয়া হয়। তা নিয়ে আন্দোলন হয় এবং সরকারের পদত্যাগও দাবি করা হয়, যদিও প্রকৃত দোষটা কার সেটা বিবেচনা করা হয় না।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যত্রতত্র যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে এবং ট্রাফিক রুলস সবাইকে মেনে চলতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলা এটা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে স্কুল পর্যায়ের প্রত্যেক জায়গাতেই এই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া দরকার।’

তিনি স্কুল পর্যায়ে এবং অফিস আদালতে সকলের জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পোস্টারিং করে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বলেন, ‘এই ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি।’

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সড়ক এবং জনপদ বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মো. একাব্বর হোসেন এবং বেনজীর আহমেদ, এমপি, সংযুক্ত ছিলেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর বনানীস্থ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ভবন মিলনায়তনে মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

এছাড়া, রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বড় পর্দার মাধ্যমে গাড়ি মাালিক এবং চালকবৃন্দ এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করেন।

টানা চতুর্থবারের মতো এবছর দেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উদযাপিত হচ্ছে।

এবারের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘মুজিববর্ষের শপথ, সড়ক করবো নিরাপদ।’

প্রধানমন্ত্রী ডাইভিং লাইসেন্সের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, অনেক সময় ড্রাইভার হেলপারের কাছে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটু বিশ্রাম করতে চায়, তারপরেই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় দেখা যায় ড্রাইভার এত ক্লান্ত থাকে যে, সে ঘুমিয়ে পড়ে এবং দুর্ঘটনা ঘটে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা হেলপারের কাজ করেন আমি মনে করি, তাদেরকেও একটু প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাদেরও যেন গাড়ি সম্পর্কে এবং গাড়ি চালনা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকে। পাশাপাশি, গাড়ির ফিটনেস বজায় রাখাটাও খুব দরকার।’

তিনি বলেন, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষাটা যেন নিয়মিত হয়, সেজন্য যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে তেমনি চালকদের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাইভেট সেক্টর বা গর্ভনমেন্ট সেক্টরের সবাইকে বলব, আপনারা যদি এভাবে করতে পারেন-এতটা সময় বা দূরত্ব একজন ড্রাইভার চালাবে, তারপরে তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে অলটারনেটিভ ড্রাইভারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা কমে যাবে।’

প্রাইভেট গাড়ি চালনার ক্ষেত্রেও তিনি নির্দিষ্ট সময় পরে চালকের বিশ্রাম এবং আহারের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন এবং তার সরকার পর্যায়ক্রমে সকল সড়কের (মহাসড়ক) পাশে বিশ্রামাগার নির্মাণ করবে বলেও উল্লেখ করেন।

পর্যায়ক্রমে সারাদেশে চালকদের জন্য বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে সরকার এবং অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘এই ড্রাইভিং শিক্ষাটাকে জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে এবং সবাইকে (চালক) ড্রাইভিং শিক্ষাটা দিতে হবে। অনলাইনেও শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে।’

শেখ হাসিনা ওভারটেকিং থেকে বিরত থাকার চন্য চালকদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘চালকদের মধ্যে একটা প্রবণতা রয়েছে ওভারটেক করা। একটা গাড়ি সামনে চলে গেছে বেহুশ হয়ে সেই গাড়িটিকে ওভারটেক করতে গিয়েই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটায়। এই প্রবণতাটাও বন্ধ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘গাড়িচালকদের নির্দিষ্ট গতিসীমা ও আইন মেনে নিরাপদে যানবাহন চালাতে হবে।’

তিনি ওভারটেকিং এবং ওভার স্পিড প্রতিরোধে সড়ক-মহাসড়কে স্পিডোমিটার লাগানোর বিষয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিন্তা-ভাবনার পরামর্শ দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সড়ক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে তার সরকার দেশের ২১টি স্থানে একমুখী ও উভয়মুখী মিলে মোট ২৮টি ‘এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন’ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সারাদেশে সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের প্রচেষ্টার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের চৌম্বক অংশ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্রাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৭ থেকে ২০২০ প্রণয়ন করেছে।

তিনি বলেন, তার সরকার ‘এসডিজি’-এর রোড-সেফটি সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ‘এসডিজি অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে।

তার সরকারের ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন’, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮,’ এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ, ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান এবং ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৬৪ জেলায় ‘ভিহেকেল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) স্থাপন করছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সারাদেশের মহাসড়কে ১৪৪টি ব্ল্যাকস্পট চিহ্নিত করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান ও বাজার এলাকায় রোড ডিভাইডার স্থাপনসহ বাঁক সরলীকরণ, রোড মার্কিং, সাইন-সিগনাল ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের ২২টি মহাসড়কে সব ধরনের থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা দেশ ধ্বংস এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির জন্য বিএনপি-জামায়াতের সরকারেরও এ সময় কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, তার সরকার ’৯৬ সালে সরকারের এসেই বিআরটিসি’র জন্য ১ হাজার নতুন বাস ক্রয় করেছিল পরবর্তীতে ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর সেগুলোর আর হদিস মেলেনি।

সরকার প্রধান বলেন, ‘আবার বিআরটিসি’র জন্য নতুন বাস ক্রয় করা হলেও বিএনপি জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে ৬শ বিআরটিসি বাস, ট্রাক এবং প্রাইভেটকারসহ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার যানবাহন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

তিনি বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে কিনে নিয়ে আসি মানুষের সুবিধার জন্য আর তা তারা ধ্বংস করে আন্দোলনের নামে, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে।’

ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মেয়েদের জন্য ২২টি বাস সার্ভিস সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে তার সরকার, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য ১৮৮টি বাস প্রদান করা হলেও অনেক স্কুলের মাঝে সরকারি বাসগ্রহণের আগ্রহ দেখা যায়নি।

তিনি অভিযোগ করেন, স্কুল পর্যায়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের সুযোগ-থাকলেও অনেক অভিভাবকই তাদের অর্থের শো-আপের জন্য পুত্র-পোষ্যকে বিলাসবহুল গাড়িতে বিদ্যালয়ে পাঠায়, যেটা এক ধরনের অহমিকা বোধ এবং এই অহমিকা একদিকে যেমন তার সন্তানের ক্ষতি করছে তেমনি যানজটও বাড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা আরো বাড়ুক, গাড়ি কেনার ক্ষমতা বাড়ুক-সে ধরনের সুযোগ আমরা করে দিচ্ছি। তারপরেও আমি বলবো, ছেলে-মেয়েকে সেভাবেই শিক্ষা দেওয়া উচিত, একই স্কুলে পড়লে তারা যেন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান না করে মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে।’

তিনি বলেন, সম্পদের অহমিকা করে লাভ নেই। আর তা নিশ্চই এই করোনাভাইরাস আসার পর মানুষ সেই শিক্ষা পেয়েছে ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থ থাকলেই সব সুবিধা ভোগ করা যায় না বা সবকিছু করা যায় না তার থেকেও শক্তিশালী কিছু থাকে। এই করোনাভাইরাস আমাদের সেই শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে।’

করোনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসে সবাইকেই স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম মেনে চলতে হবে।

করোনার সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহারের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী এবং সিনেথেটিকের পরিবর্তে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সহজলভ্য বিবেচনায় কাপড়ের মাস্ক ব্যবহারেরই পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি গাড়ি চালবার সময় চালকদেরকেও মাস্ক ব্যবহারের আহ্বান জানান।

Comments

The Daily Star  | English
Yunus meets Malaysian PM Anwar Ibrahim

Anwar Ibrahim to consider issue of Bangladeshi workers

Malaysian Prime Minister Anwar Ibrahim today promised to consider the issue of 18,000 Bangladeshi workers who missed a deadline to enter Malaysia saying that they need workers, but not "modern slaves"

4h ago