ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের ফাঁদে মোবাইল গ্রাহকরা
বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মোবাইল ব্যবহারকারী ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভিএএস) ব্যবহার করেন। অবশ্য ব্যবহার করেন না বলে ভিএএসের জন্য শুধু টাকা পরিশোধ করেন বললে সেটাই সঠিক হয়। কারণ, এই সার্ভিসগুলো বেশিরভাগ গ্রাহক নিজেদের ইচ্ছায় নেন না। বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) এক তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রাহকের অজান্তেই এসব সার্ভিস চালু হয়ে যাচ্ছে।
এ ধরনের সার্ভিস থেকে গ্রাহকদের বাঁচাতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে উত্সাহিত করে বিটিআরসি।
টেলিযোগাযোগ খাতে ভিএএসের মধ্যে রয়েছে ওয়েলকাম টিউন, ভয়েস ম্যাসেজ, নিউজ অ্যালার্ট, মিসড কল অ্যালার্ট, কল ব্লক, কল ফরওয়ার্ডিং বা ডাইভার্টিং, গান, ভিডিও, মোবাইল গেমস ও স্ট্রিমিং, মোবাইলের ব্যালেন্স থেকে অন্য মোবাইলে টাকা পাঠানো। এই সার্ভিসগুলো যারা প্রদান করে তারা মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে আয় ভাগাভাগি করে নেওয়ার চুক্তি করেন। এসব সার্ভিসের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেয় মোবাইল অপররেটররা।
এ ধরনের যেকোনো সার্ভিস চালু করতে হলে গ্রাহকের সম্মতি গ্রহণ করতে হয়। তবে, প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হচ্ছে না, অথচ এর জন্য তাদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। দুটি ভিএএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগে গঠিত বিটিআরসির তদন্তে এই অভিযোগ আনা হয়েছে।
পার্পল ডিজিট কমিউনিকেশন লিমিটেড এবং অভি কথাচিত্র লিমিটেডের কার্যক্রম ও গত ছয় মাসে তাদের গ্রাহক তালিকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে বিটিআরসি। গ্রাহকরা এসব সার্ভিস নেওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করেছেন কি না, তা জানতে সরাসরি গ্রাহকদের কল দেয় বিটিআরসির সিস্টেম ও সার্ভিস বিভাগের কর্মকর্তারা।
পার্পল ডিজিটের দুইটি সার্ভিস ব্যবহারকারীদের মধ্য থেকে কল দেওয়ার জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১০০ গ্রাহক নির্বাচন করা হয়। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ জানান, এমন কোনো সার্ভিসের জন্য তারা সম্মতি দেননি এবং ১৭ শতাংশ জানান, তারা এই সার্ভিস নিজেদের ইচ্ছাতেই নিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের দুটি সার্ভিস প্রায় ৭৬ হাজার ৮৬০ জন গ্রাহক ব্যবহার করেন।
অভি কথাচিত্রের তিন লাখ ৫৮ হাজার ৭২২ জন গ্রাহকের মধ্যে কল দেওয়া হয়েছে ৯০ জনকে। তাদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ বলেছেন, তারা এ জাতীয় কোনো সার্ভিস নেওয়ার জন্য সম্মতি দেননি।
বিটিআরসির এক নথি অনুযায়ী, দুটি প্রতিষ্ঠানকেই তলব করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অভিযোগ স্বীকার করলেও কোনো লিখিত বিবৃতি দেননি।
অভি কথাচিত্র আগস্টে তাদের সার্ভিস ঢালিউড ২৪ নিউজ অ্যালার্ট থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা নিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটররা নিয়েছে ২৬ লাখ টাকা।
পার্পল ডিজিট ইকরা সার্ভিসের মাধ্যমে এপ্রিল মাসে পেয়েছে ৩০ লাখ টাকা।
বিটিআরসি জানিয়েছে, রবি আজিয়াটা ও বাংলালিংক যথাক্রমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফোন অপারেটর। বিটিআরসি জানিয়েছে, এই দুটি অপারেটর পার্পল ডিজিট ও অভি কথাচিত্রের মাধ্যমে ভিএএসগুলো তাদের গ্রাহকদের দিয়ে আসছে।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দায় স্বীকার না করলেও মোবাইল ফোন অপারেটররা লাভের অংশ নিয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘যদি মোবাইল ফোন অপারেটররা চাইত তাহলে গ্রাহকদের মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স থেকে চুরি করে অর্থ কেটে নেওয়া সম্ভব হতো না। মোবাইল ফোন অপারেটররা তাদের দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না।’
বিটিআরসি দেখতে পায়, ভিএএস দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলত ফিচার ফোন ব্যবহারকারী গ্রাহকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয় এবং সার্ভিসগুলো মধ্যরাতের পরে সক্রিয় করা হয়।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, ‘আমরা সার্ভিসগুলো একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায় আনতে চাইছি। এই সার্ভিসগুলো গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ তারা এ সম্পর্কে জানেন না। এটাই আমাদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।’
গ্রাহকদের সম্মতি ছাড়া ভিএএস চালুর মাধ্যমে প্রতারণা এবং কেটে নেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
একইভাবে, মোবাইল ফোন অপারেটরদেরও অর্থ ফেরত দিতে বলা যেতে পারে এবং জরিমানাও করা হতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছে।
বিটিআরসির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে টেলিকম খাতে ভিএএস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ১৮৩টি।
গ্রাহক-স্বার্থ রক্ষায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর মোবাইল ফোন অপারেটরদের ভিএএস সক্রিয় করতে ওটিপির ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই ব্যবস্থা না করা হলে চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকে মোবাইল ফোন অপারেটররা সব ভিএএস বন্ধ করার ব্যবস্থা নেবে।
রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি কর্মকর্তা শাহেদ আলম বলেন, ‘ভিএএস অপারেটরগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে। সুতরাং, ভিএএস নিয়ে যে সমস্যাগুলো উদ্বেগের সেগুলোর প্রাথমিক দায়ভার কোনোভাবেই মোবাইল অপারেটরদের ওপর থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভিএএস আমাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিতরণ করা হচ্ছে। তাই যেকোনো অব্যবস্থাপনা বন্ধে আমরা বিটিআরসির সঙ্গে কাজ করতে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা অবৈধ কার্যক্রম মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি। ডিজিটাল জালিয়াতি একটি সামাজিক অসুস্থতা এবং আমাদের একসঙ্গে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।’
ভিএএস সরবরাহকারীরা বিটিআরসি থেকে নিবন্ধন পান এবং তারা এই সার্ভিসের মালিক জানিয়ে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি কর্মকর্তা তাইমুর রহমান বলেন, ‘যখনই আমরা গ্রাহকদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাই, আমরা বিষয়টি তদন্ত করি এবং ভিএএস সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। যার কারণে মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।’
দেশে টেলিকম খাতে ভিএএস বাজারের আকার প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে জানান প্রস্তাবিত কন্টেন্ট প্রভাইডার অ্যান্ড অ্যাগ্রিগেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রাফিউর রহমান খান ইউসুফজাই।
তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসা বাংলাদেশে নতুন। তাই কমিশন, মোবাইল ফোন অপারেটর এবং ভিএএস সরবরাহকারীদের একসঙ্গে বসে সমাধান বের করতে হবে, যাতে এই খাত আরও এগিয়ে যেতে পারে।’
প্রায় তিন হাজার আইটি গ্র্যাজুয়েট এই খাতে কাজ করে।
Comments