চলচ্চিত্রে অনুদান: অপচয়ের দায় কি কেবল নির্মাতার?
নির্মাতার আগে সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, যেহেতু জাতীয় পত্রিকার রাজনীতি ও সংসদ বিটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কাজ করেছি বছরের পর বছর। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে এখনো লেখালেখি করার পরও গণমাধ্যমে কর্মরত সহকর্মী ও বন্ধুরা আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে চান।
সাংবাদিক না নির্মাতা, প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ কি না জানি না, দুই জায়গায় কাজ করেই আমি গর্বিত। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে কোনো কিছু সাংঘর্ষিক হলে তখন নিজেকে নিরপেক্ষ রাখতে পারি না। সত্যের পক্ষ নেই। আজকের লেখা কোনো নির্মাতাকে আঘাত করার জন্য নয়। তবুও কারো মনোকষ্টের কারণ হলে আগাম ক্ষমা চাচ্ছি।
লেখার শুরুতেই আশা করছি যে, আজ সোমবার বিজ্ঞ আদালত কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুরকে জামিনে মুক্ত করে দেবেন। নাগরিক হিসেবে জামিনপ্রাপ্তি তার মৌলিক অধিকারের একটি। যদিও মানুষের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা সব সময় রাষ্ট্র দিতে পারে না বা দিতে ব্যর্থ হয়। এমন অসংখ্য নজির আমরা দেখতে পাই। সম্প্রতি ফটোসাংবাদিক কাজলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দিতে পারেনি।
টোকন ঠাকুর দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি। আদালতের পরোয়ানায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের করা মামলায় সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সরকারি অনুদানে নির্মাণাধীন চলচ্চিত্র ‘কাঁটা’ সময়মতো জমা না দিয়ে সরকারি সম্পদ তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছে দেশের অন্যতম একজন কবির বিরুদ্ধে। যেহেতু অভিযোগটির সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষ এবং জামিনে মুক্ত হলে টোকন ঠাকুরের মতো প্রতিষ্ঠিত কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতার পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই, তাই আদালত বিষয়টি বিবেচনা করে পরবর্তী কার্যদিবসে তার জামিন মঞ্জুর করবেন বলে বিশ্বাস করি।
২০১২-১৩ সালে কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের ছোটগল্প ‘কাঁটা’ অবলম্বনে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদানের জন্য মনোনীত হলেও তিনি পুরো টাকা পাননি বলে অভিযোগ আছে। বরাদ্দ পাওয়া ৩৫ লাখ টাকা থেকে নির্মাতা টোকন ঠাকুর সাড়ে ১০ লাখ টাকা তুলেছিলেন এবং সিনেমার শুটিং শেষ করে ফুটেজও জমা দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। প্রোডাকশন পর্যায়ে বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার তার স্বপ্নের ছবি ‘কাঁটা’র পোস্ট প্রোডাকশন শেষ করার আর্থিক সঙ্গতি নেই বলে আলোচনা ছিল চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
এ কথা অবিশ্বাস্য যে, কোনো নির্মাতা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেলে তা আত্মসাৎ করবেন। তবে, বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেওয়া হয়, তাতে সরকারি টাকা অপচয়ের সুযোগ আছে এবং তা হচ্ছেও বছরের পর বছর ধরে। কাদের, কী কারণে ও কোন পদ্ধতিতে অনুদানের জন্য মনোনীত করা হয়, সেই প্রশ্নও আছে। সঙ্গে অস্বচ্ছতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। অনুদান না পেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাও দেখা গেছে। এ বিষয়ে আরও অভিযোগ অনেকের আছে এবং আলোচনা শুরুর এখনই সময়।
চলচ্চিত্র নির্মাণ শিশুর ঘুমপাড়ানি গান গাওয়ার মতো সহজ কাজ নয়। মেধার পাশাপাশি কার্যনির্বাহের অভিজ্ঞতা লাগে। মেধাবী পরিচালকের সঙ্গে পেশাদার প্রযোজকও অপরিহার্য একটা সিনেমার নির্মাণ শেষ করে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি পরিচালক-প্রযোজকের অতীত চলচ্চিত্রের মান বিবেচনা এবং প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে মনোনীত করবেন, এটাই পেশাদারিত্ব। এক্ষেত্রে তারা কতটুকু পেশাদার, এর প্রমাণ সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না অনুদানের জন্য মনোনীত তালিকা বিশ্লেষণ করলে।
অভিযোগ আছে, যোগাযোগ, তদবির ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদাররাই বছর বছর অনুদান বাগিয়ে নেন। ফলে রাষ্ট্রের টাকার কেবল অপচয় হয়। এভাবে মানসম্মত চলচ্চিত্রকে পৃষ্ঠপোষকতার সরকারি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা দুরূহ ব্যাপার।
ধরা যাক, একজন পরিচালক এবং একজন প্রযোজক তাদের প্রস্তাবিত ছবির জন্য অনুদানের আবেদন করলেন। সিনেমার মোট বাজেট এক কোটি টাকা। আর সরকারি অনুদান ৫০ লাখ টাকা। বাজেটের বাকি অংশ কোথা থেকে আসবে? প্রযোজকের কি বাকি অর্থ জোগাড়ের সক্ষমতা আছে? প্রস্তাবিত বাজেটের মধ্যে তার এই কাজ নির্বাহের সক্ষমতা ও অতীত অভিজ্ঞতা আছে কি না?
এসব প্রশ্নের উত্তর অনুদান কমিটি খুঁজে বলে মনে হয় না। ফলে অনুদানের টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। এমনটিই ঘটেছে টোকন ঠাকুরের সিনেমা ‘কাঁটা’র ক্ষেত্রে। শোনা যায়, টোকন ঠাকুর প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছেন শুটিং শেষ করতেই। সিনেমা প্রযোজনার অতীত অভিজ্ঞতা তার ছিল না। এখনো বাকি আছে এডিট, সাউন্ড, ডিআইসহ পোস্ট প্রোডাকশনের যাবতীয় কাজ। বিভিন্ন পর্যায়ে আর্থিক সংকটের কারণে শুটিং শেষ করতেই তার সময় লেগেছে দীর্ঘ সাত বছর। এজন্য অনুদান-গ্রহীতা নির্মাতা টোকন ঠাকুরকে নাকি অনুদানের পদ্ধতিকে দায়ী করা হবে, প্রশ্নটা উঠতেই পারে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এদেশে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি, সরকারি টাকা লুটপাটকারী কিংবা সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকা পাচারকারী গ্রেপ্তার হয় না। অথচ মাত্র সাড়ে ১০ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে সময়মতো সিনেমা জমা না দেওয়ার কারণে কবি ও নির্মাতা টোকন ঠাকুর হাজতে গেলেন। যা গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু তিনি টাকা আত্মসাৎ করেননি, তাই বিষয়টা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব ছিল। মনে রাখা দরকার ছিল, একটি চলচ্চিত্র শেষ করতে নির্মাতাকে পাহাড় সমান বাধা ডিঙাতে হয়। এটা সকলেরই জানা। এক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় এই বিতর্কিত অনুদান পদ্ধতি সংশোধন ও স্বচ্ছ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আগে করুক। তাহলে ভবিষ্যতে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে।
জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments