প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতায় নির্বিকার জাবি প্রশাসন

দায়িত্ব নেওয়ার পর চার বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিনের বিরুদ্ধে লাঞ্ছিত করা, মারধর, ব্ল্যাকমেইল, চাঁদাবাজি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা নারী দর্শনার্থীদের কটূক্তি করার এক ডজনেরও বেশি অভিযোগ জমা পরেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিন। ছবি: সংগৃহীত

দায়িত্ব নেওয়ার পর চার বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিনের বিরুদ্ধে লাঞ্ছিত করা, মারধর, ব্ল্যাকমেইল, চাঁদাবাজি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসা নারী দর্শনার্থীদের কটূক্তি করার এক ডজনেরও বেশি অভিযোগ জমা পরেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।

তার কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের পাশাপাশি ক্যাম্পাসের ভেতরের ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে। তাদের অনেককে লাঞ্ছিত করেছেন, এমনকি পিটিয়ে মারাত্মক জখমও করেছেন সুদীপ্ত শাহিন।

অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শাহিনের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে তার দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক কর্মচারীকে চাকরি থেকে সাময়িক বহিষ্কার করার অভিযোগ রয়েছে।

ঘটনা ঘটার পর দেওয়া অভিযোগের বিচারের অগ্রগতি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধু বলেন, ‘তদন্ত চলছে….’।

দ্য ডেইলি স্টার ৪৫ বছর বয়সী এই প্রধান নিরাপত্তা কর্মীর বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগগুলোর বেশিরভাগের অনুলিপি হাতে পেয়েছে।

অভিযোগের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও লাঞ্ছিত করার ঘটনাও রয়েছে।

দুটি পৃথক ঘটনায় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল। একটি অভিযোগে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকা রসায়ন বিভাগের দুই শিক্ষকের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছিলেন শাহীন। অপর অভিযোগে বলা হয়েছে, জাবির মূল ফটকের কাছে দোকান পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন তিনি।

কেউ কেউ শাহিনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে মৌখিকভাবেও অভিযোগ করেছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, অনেকে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিযোগ করেননি ভয়ে।

কর্তৃপক্ষের কাছে করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের নৃশংসভাবে মারধর করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে এবং তারা যদি এসব কাউকে জানায় তবে ভয়াবহ পরিণতি হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

তার নির্যাতনের সর্বশেষ শিকার হয়েছেন নাহিদ হোসেন নামের এক ভ্যানচালক। ক্যাম্পাসের ভেতরে ভ্যান নেওয়ায় শাহিন তাকে কয়েক ঘণ্টা লাঠি দিয়ে মারধর করেন। এতে তার পা ভেঙে যায়।

নাহিদ হোসেন জানান, সুদীপ্ত শাহিন তাকে ১৬ অক্টোবর চৌরঙ্গী এলাকা থেকে আটক করে জাবির নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যান।

গত ২০ অক্টোবর নাহিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিনি (শাহীন) প্রথমে তার পুরো শক্তি খাটিয়ে আমার কানের ওপর চড় মারেন। তারপরে সে আমাকে বার বার লাথি মারতে থাকেন। আমি মাটিতে পড়ে যাই। সেখানে উজ্জ্বল নামের একজন নিরাপত্তা কর্মী আমাকে ধরে রাখেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তিন ঘণ্টা সেখানে আটকে আমাকে লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে মারধর করেন শাহিন। আমি চিৎকার করতে থাকলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন যে, আমার মুখে তোয়ালে ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর মারবেন।’

নাহিদ জানান, তাকে এই শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে, সে কাউকে কিছু বলবে না। না হলে তাকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার আগে ক্যাম্পাসে চা-স্টল চালাতেন নাহিদ। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘এই ভাঙা পা নিয়ে এখন সংসার চালাব কীভাবে?’

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে শাহীন বলেন, তিনি শুধু তার ‘দায়িত্ব’ পালন করেছেন।

শিক্ষার্থীরা জানান, শাহীনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা মানুষ, বিশেষ করে দম্পতিরা। তাদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে ‘অশালীন আচরণ’ করার অভিযোগ তুলে হয়রানি করা হয়।

২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বান্ধবীকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যান মোহাম্মদ শামীম (২৭)। তাদের নিজের অফিসে নিয়ে যান সুদীপ্ত শাহিন।

শামীম জানান, সেখানে নিয়ে তাকে পাইপ ও লাঠি দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে মারধর করা হয়। তারপর শাহীন তার পকেটে গাঁজা এবং কার্তুজ ভরে দেন এবং হুমকি দিয়ে বলেন, পুলিশ বা সাংবাদিকদের এ কথা জানালে তার জীবন নষ্ট করে দেবেন।

২০১৯ সালে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল বুয়েটের এক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শরীফ মিয়ার সঙ্গে।

শরীফ মিয়াকে মারধরের প্রতিবাদে ঐ রাতেই উপচার্যের বাসার সামনে সুদীপ্ত শাহীনের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা।

গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন নারী সংবাদ উপস্থাপিকাকে ক্যাম্পাসে থাকার কারণে কটূক্তি ও হুমকি প্রদান করেন সুদীপ্ত শাহিন। 

যোগাযোগ করা হলে জাবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, ‘সব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সুদীপ্ত শাহিনের নামে পূর্বের একটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তা জানতে চাইলে গত বছরও রহিমা কানিজ একই কথা বলেছিলেন।

এবার তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। করোনাভাইরাস লকডাউনের কারণে তাদের কাজে দেরি হয়েছে।’

সুদীপ্ত শাহিনের বিরুদ্ধে কয়টি অভিযোগ রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে রহিমা কানিজ জানান, তিনি সংখ্যা মনে করতে পারছেন না।

এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান জাবির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন, ‘শাহিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে সেগুলো পাঠানো বাকি। আমরা খুব দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিব।’

তিনি জানান, তদন্ত কমিটির কোনো টাইপিস্ট না থাকায় প্রতিবেদন লিখতে দেরি হচ্ছে।

এর আগে শাহিনের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরও একটি কমিটি গঠন করেছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘আমরা গত বছর অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করেছি। তবে কর্তৃপক্ষ এখনও সেটি সিন্ডিকেট সভায় তোলেননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি তদন্ত চলাকালীন সময়ে তাকে নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়নি। জবাবদিহিতা ও শাস্তির অভাবে এই কর্মকর্তা দিনের পর দিন অপরাধ করেই চলেছেন।’

যোগাযোগ করা হলে নাহিদ বা অন্য কাউকে ক্যাম্পাসে মারধর করার বিষয়টি অস্বীকার করেন সুদীপ্ত শাহিন।

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমি মাদকের কয়েকটি স্পট বন্ধ করেছি। সেই সঙ্গে এমন কিছু জায়গা বন্ধ করে দিয়েছি যেখানে অশ্লীল কার্যক্রম হয়। এজন্যই অনেকের কাছে আমি চক্ষুশূল হয়ে গেছি। আমি শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করেছি।’

একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা হয়ে কারও গায়ে হাত তুলতে পারেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহীন বলেন, ‘না, তা আমি করতে পারি না। আমি কখনও কারও গায়ে হাত তুলিনি। নাহিদের ব্যাপারে আমাকে দোষারোপ করা হচ্ছে, আমি তাকে টাচও করিনি। আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় আমার অফিসেই ছিলাম।’

রিক্সাচালক, বহিরাগতদের গায়ে হাত তুলতে দেখেছেন বলে একাধিক শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী দ্য ডেইলি স্টারের কাছে দাবি করেন। এছাড়াও মারধরের ঘটনায় আহত একাধিক ব্যক্তির ছবিও সংগৃহীত দ্য ডেইলি স্টারের কাছে রয়েছে।

সুদীপ্ত শাহীনের অপসারণসহ চার দফা দাবিতে গণস্বাক্ষর ও সাক্ষী সংগ্রহের অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করেন সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এতে প্রায় ৮৬০ জন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী সাক্ষর করেন এবং সুদীপ্ত শাহীনের হাতে হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেন প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী।

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago