সিসিটিভি ফুটেজ ও সাদা পোশাকে তুলে নেওয়ার পরের গল্প

রাজধানীর পল্টনে হোটেল বন্ধুর ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বরের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে, সাদা পোশাকে কয়েকজনের একটি দল হোটেল ম্যানেজার হাসান মজুমদার ও শেফ সোহেল রানাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর আগের ফুটেজে দেখা যায়, দলের এক সদস্য হোটেলের কোনও কর্মচারীকে সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করার জন্য বলছে। পরে, সেটি বন্ধও হয়ে যায়।

হোটেল ম্যানেজার ও শেফকে পল্টনের হোটেল থেকে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে মাইক্রোবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দুজন বলছেন ডিবি পুলিশের লোকেরা সাদা পোশাকে তাদের আটক করে নিয়ে গেছেন।

ওই এলাকার অন্তত ২০ জন লোক দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিল যে তারা সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। দ্য ডেইলি স্টার ওই সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনাও করেছে।

সাত তলা মার্কেটের নিচ তলায় বন্ধু হোটেল। নিচ তলার আরও একটি ক্যামেরায় দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটের ফুটেজে দুজনকে নিয়ে যাওয়ার ছবি পাওয়া গেছে।

এ ঘটনার পরদিন ৭ নভেম্বর পুলিশ প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) তৈরি করে। সেখানে, গল্পটা পুরোই অন্যরকম। সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই।

মতিঝিল থানায় করা ওই এফআইআর অনুযায়ী, বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ফকিরাপুল মাছ বাজার এলাকা থেকে হাসান ও সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৫ লাখ টাকার জাল নোট নিয়ে সেখান থেকে পালানোর সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে এফআইআর এ উল্লেখ করা হয়েছে।

হোটেল ম্যানেজার হাসান মজুমদারের অভিযোগ, এফআইআর ও পরবর্তী মামলাটি ডিবি পুলিশের বানানো গল্প।

তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিন লাখ টাকা দাবি করে। আমরা দিতে অস্বীকার করায় মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়েছে।'

২০১৭ সালের এপ্রিলে জামিনে মুক্তি পেয়ে হাসান বলেছিলেন, আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আগে তিনি দুদিনের পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন। এরপর তিনি পাঁচ মাস ১৭ দিন কারাভোগ করেন।

'এটি আমার দীর্ঘ দুর্ভোগের কেবল শুরু', যোগ করেন হাসান। গত দীর্ঘ চার বছর ধরে ন্যায়বিচার পেতে তিনি বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তদন্ত হলেও, কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

হাসান ও তার ভাই হোসেন মজুমদার এ ঘটনার বিষয়ে গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে ১০টি অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি, ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) দুটি, একটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং একটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

বিতর্কিত অভিযান পরিচালনাকারী মতিঝিল জোনাল টিমের নয় জন ডিবি সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর তিনটি এবং ডিএমপি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।

নয় জন ডিবি সদস্য হলেন--উপপরিদর্শক (এসআই) দেওয়ান উজ্জ্বল হোসেন, পরিদর্শক তপন কুমার ঢালী, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জিয়াউর রহমান, এএসআই সোহেল মাহমুদ, এএসআই আবুল বাশার, এএসআই মমিনুল হক, এএসআই নাজমুল হক প্রধান এবং কনস্টেবল নয়ন কুমার ও গোলাম সরোয়ার।

এই দলের দায়িত্বে ছিলেন ডিবির (পূর্ব) তৎকালীন সহকারী কমিশনার জুয়েল রানা। তিনি এখন অতিরিক্ত উপকমিশনার।

তবে, এই একাধিক তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানে কী পেয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।

ডিএমপি গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির একটির প্রধান এসপি শরীফ জানান, তিনি উভয় পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

তিনি সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি একটি গোপনীয় বিষয়। আমি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারি না।'

এই অভিযোগের পুনরায় তদন্তে ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহেদ মিয়াকে ২০১৭ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

তিনি এই প্রতিবেদকের ফোন কল রিসিভ করেননি কিংবা মেসেজেরও উত্তর জানাননি।

ডিএমপিতে করা অভিযোগের তদন্তকারী ডিবি পুলিশের এডিসি কাজী শফিকুল ইসলামও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

২০১৮ সালে তৎকালীন ডিবি প্রধান দেবদাস ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপি। দেবদাস ডিএমপি থেকে বদলি হওয়ায় তদন্তকাজের কী হয়েছিল, তা এখনও অজানা।

পুলিশ সদর দপ্তরে করা অভিযোগের তিনটি তদন্ত কমিটির মধ্যে একটির দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসপি ওমর ফারুক বলেন, হাসানের ভাই অভিযোগ প্রত্যাহারের পর, তিনি আর তদন্তকাজ চালাননি।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এএসপি ওমর বলেন, অভিযোগকারী ও অভিযুক্তরা বিষয়টি নিজেরা 'নিষ্পত্তি' করার পর্যায়ে পৌঁছালে, তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

'যদি অভিযোগকারী নিজেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন, তবে আমি কীভাবে তদন্ত চালাবো,' বলেন তিনি।

হাসান অবশ্য বলেন যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্র থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে, অভিযুক্ত ডিবি কর্মকর্তাদের এমন মৌখিক আশ্বাসের পর, তারা অভিযোগটি প্রত্যাহার করে নেয়।

হাসান বলেন, 'তবে, যখন শুনলাম যে অভিযোগপত্রে আমার নাম আছে, তখন মনে হলো যে প্রতারিত হয়েছি।'

হাসানের পক্ষে বিষয়টি আরও খারাপ হয় যখন বিতর্কিত ওই অভিযান পরিচালনাকারী ডিবি পুলিশের এসআই দেওয়ান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান এবং তিনি হাসান ও সোহেল উভয়কেই অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

আসল প্রত্যক্ষদর্শীরা কোথায়?

এসআই দেওয়ান ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। তিনি ১৩ জনকে সাক্ষী হিসেবে দেখান। তাদের মধ্যে নয় জন ওই অভিযান পরিচালনাকারী ও চার জন মতিঝিল এলাকার স্থানীয়।

ফকিরাপুল মাছ বাজারের ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করা মো. মিন্টু বলেন, 'সেদিন আমি যা দেখেছি, পুলিশ ও আদালতকে তা বলেছি। আমি দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখেছি, যাদের পুলিশ একটি ব্যাগসহ ধরে।'

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা আরেক সাক্ষী মো. রাজুর ফোন বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। মিন্টু দাবি করেন, তিনি ও রাজু দুজনই জব্দ তালিকায় সই করেছেন।

পুলিশ গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত চলাকালে বিভিন্ন সময়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পল্টনের ২৩টি দোকান মালিক ও কর্মচারীদের ডাকে।

তাদের মধ্যে একজন এআর মেটালিকের আনোয়ার হোসেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'আমরা দেখলাম একদল ডিবি এসে হোটেলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে। ততক্ষণে তারা হাসান ভাইয়ের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয়।'

তিনি বলেন, 'তারা হোটেলের এক কর্মচারীকে সিসিটিভি বন্ধ করতে বলে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি যে কেন তারা হোটেলের লোকদের হাতকড়া পরাচ্ছে। তাদের দোষ কী? তখন তারা ধমক দিয়ে আমাদের চলে যেতে বলে।'

আনোয়ার আরও জানান, হাসান ও সোহেলের হাতে সে সময় কিছুই ছিল না। পুলিশের তদন্তের সময় তিনি এসব  বলেছিলেন।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী টেলিপ্লাসের মো. মাসুম একই কথা বলেন।

সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে পুলিশের নীরবতা

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই দেওয়ান জানান, বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, 'আমি সবকিছু যাচাই করেছি। এখন আর কোনও মন্তব্য করতে পারছি না।'

মামলার বাদী পুলিশ পরিদর্শক তপন এখন ফরিদপুরের পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনে কর্মরত আছেন। তিনিও সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে ওই ডিবি দলের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

যোগাযোগ করা হলে ডিবি'র রমনা বিভাগের বর্তমান এডিসি জুয়েল রানা শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান যে মামলা বিচারাধীন থাকায়, তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না।

দুই জনের মুক্তির জন্য অর্থ দাবির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'অভিযুক্ত ও ডিবি সদস্যদের মধ্যে যে "মীমাংসা" হয়েছে সে সম্পর্কেও তিনি জানতেন না।'

'আমি যতদূর জানি, তদন্ত কমিটি ডিবি সদস্যদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোর কোনও সত্যতা পায়নি। অভিযুক্তরা যখন দেখল যে তাদের মিথ্যা আবেদন কোথাও মঞ্জুর হয়নি, তখন তারা আমাদের ফাঁসাতে চেয়েছিল,' যোগ করেন তিনি।

হাসানের লড়াই চলমান

হাসান জানান, মামলার আইনি খরচ মেটাতে তার পরিবার ইতিমধ্যে জমি বিক্রি করে ছয় লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

তিনি বলেন, 'আমাকে গ্রেপ্তারের পর পরিবারের আর্থিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায়, আমার ভাইয়ের পড়াশোনা প্রায় বন্ধই হয়ে যায়।'

হাসান বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ তার নির্দোষ থাকা প্রমাণ করতে পারে এবং তিনি পুলিশের মিথ্যাচারের শিকার।

হাসানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান জানান, যখন তাদের যুক্তি ও সাক্ষী পেশ করার সময় আসবে, তখন তারা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং সিসিটিভি ফুটেজ জমা দেবেন।

আজ এ মামলার শুনানিতে বাদীপক্ষের দুই সাক্ষী উপস্থিত না থাকায়, আগামী ২৪ নভেম্বর আদালত মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন।

হাসান বলেন, 'আমি গত চার বছর ধরে বিচার চেয়েছি। যেখানে যেখানে সম্ভব, সেখানেই অভিযোগ করেছি। তবুও, এই কর্মকর্তাদের কোনও শাস্তি কেউ দিচ্ছে না।'

'আমি আর কতদিন মিথ্যা মামলার দায় নিয়ে থাকব,' বলেন তিনি।

হাসানের সঙ্গে আটক হোটেল বন্ধু'র শেফ সোহেল রানা চাকরি ছেড়ে এখন চাঁদপুরে থাকেন।

সেই দিনগুলোর ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'এক পর্যায়ে ডিবি কর্মকর্তারা আমাকে পাঁচ লাখ টাকা ও চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে হাসান ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, আমি তা করতে রাজি হইনি।'

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সোহেল জানান, গত চার বছর ধরে পরিবারের ব্যয় মেটাতে তার মাকে তাদের শেষ জমিটুকুও বিক্রি করতে হয়েছে।

গতকাল ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ চলাকালে তিনি আজকের শুনানিতে অংশ নিতে চাঁদপুর থেকে ঢাকা আসছিলেন।

এ ঘটনা সম্পর্কে বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চার্জশিটের হেরফের, মিথ্যা সাক্ষী তৈরি করা, ঘটনার স্থান বদলে দেওয়া 'নতুন কিছু নয়'।

'দুর্ভাগ্যবশত, যখন কোনও ভুক্তভোগী উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রতিকার চান, তখন সম্ভবত তারা এই অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দেন না,' যোগ করেন তিনি।

তিনি এই বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'বেশিরভাগ সময় এই জাতীয় ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশও করা হয় না।'

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

10h ago