নামমাত্র দামে জমি বিক্রি, না হলে নির্যাতন

পুরান ঢাকার চকবাজারের ব্যবসায়ী আফতাব আহমেদ। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তার দোকানের একটি অংশ ভেঙে দেন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ক্যাডাররা। শতবর্ষী পুরনো ভবনটিতে দোকানের বাকি অংশটুকু বাঁচানোর সাধ্যের সবই করেছিলেন তিনি।
ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। ছবি: সংগৃহীত

পুরান ঢাকার চকবাজারের ব্যবসায়ী আফতাব আহমেদ। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তার দোকানের একটি অংশ ভেঙে দেন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ক্যাডাররা। শতবর্ষী পুরনো ভবনটিতে দোকানের বাকি অংশটুকু বাঁচানোর সাধ্যের সবই করেছিলেন তিনি।

কিন্তু, ২০১৯ সালের ৫ জুন দোকানের বাকি অংশও ভেঙে ফেলা হয়। সবাই যখন ঈদের ছুটিতে, তখন আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের লোকেরা স্থানীয়ভাবে ‘জাহাজ বাড়ি’ নামে পরিচিত ভবনটি পুরো ধ্বংস করে দেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। ভবনটি দেখতে জাহাজের মতো ছিল বলে স্থানীয়দের কাছে এটি জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত ছিল।

উনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি এবং ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে বিবেচিত এই ভবনটি নান্দনিক মানের জন্য খ্যাতি পেয়েছিল। ২০১৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে উল্লেখযোগ্য দুই হাজার ২০০টি ভবন ভেঙে না ফেলতে বা ভবনে পরিবর্তন না করতে নির্দেশনা দেওয়া হয় উচ্চ আদালত থেকে। এই ভবনটিও এই আদেশের অন্তর্গত ছিল।

এ ছাড়াও, এই জমিটি ওয়াকফ এস্টেটের অন্তর্গত। ফলে, ভবনটি ভাঙতে বা সেখানে নতুন কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। ওয়াকফ করা জমি ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া হস্তান্তরও অবৈধ।

ভবনটি ভেঙে ফেলার পরে ওয়াকফ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, ভাঙার জন্য কেউই কোনো অনুমতি নেয়নি।

কোনো নিয়মই ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমকে থামাতে পারেনি। সূত্র জানায়, ভবনটি ভাঙার সময় হাজী সেলিম সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে তিনি তিন তলা ওই ভবনটি কিনে নিয়েছেন।

জাহাজ বাড়িতে দোকান ছিল এমন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী দাবি করেন, অর্থের বিনিময়ে দোকান মালিকদের সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছিলেন হাজী সেলিম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যারা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি হননি, তাদের নিজের টর্চার সেলে নিয়ে যান হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের ক্যাডাররা। সেখানে তাদের ওপর নির্যাতন করা হতো।’

নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানের ওপর হামলার পর ইরফানকে গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে পিতা-পুত্রের এমন বেশ কিছু অপকর্ম প্রকাশ্যে আসে।

জাহাজ বাড়ির সম্পত্তি দখল তার মধ্যে অন্যতম একটি উদাহরণ।

দ্য ডেইলি স্টার অন্তত ২০ জন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে যে হাজী সেলিমের পরিবার ঢাকার বিভিন্ন জায়গার ওয়াকফ এস্টেটের মালিকানাধীন সম্পত্তি এমনকি দোকানসহ উচ্চমূল্যের জমি দখল করে নিয়েছে।

হাজী সেলিমের ভয়ে তাদের কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

চকবাজার, ইমামগঞ্জ, বেগমবাজার, বিরেন্দ্র বোস স্ট্রিট, কেল্লার মোড়ের জোলা পট্টিতে জমি, ভবন ও মার্কেট দখল ছাড়াও গাবতলি ও বাবুবাজারের মধ্যে ভাওয়াল এস্টেটের ইমামগঞ্জ রাজারবাড়ির জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে হাজী সেলিমের পরিবারের বিরুদ্ধে।

হাজি সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী সোহেল আহমেদ জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, জাহাজ বাড়ি ভাঙার সময় এই সংসদ সদস্য বিদেশে ছিলেন।

গত মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘জাহাজ বাড়ি কে ভেঙেছে তা আমরা জানি না।’

হাজী সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার কথা বলতে পারবেন না। তিনি শুধু চলাফেরা করতে পারেন এবং অন্যান্য কাজ করতে পারেন।’

এই আইন প্রণেতার অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দ্য ডেইলি স্টার। কিন্তু, তাদের কেউই কথা বলতে রাজি হননি।

গত সোমবার র‌্যাবের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ইরফানকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। ইরফানকে গ্রেপ্তারের পর চকবাজারে ইরফানের বাসা থেকে কয়েক গজ দূরের হাজী সেলিমের মালিকানাধীন ১৬ তলা মদিনা আশিক টাওয়ারে তার টর্চার সেলের খোঁজ পায়।

জমি দখলের কৌশল

পুরান ঢাকার কোনো জমি নিয়ে যখনই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিত, তখনই হাজী সেলিম সেখানে সালিশ করতে ছুটে যেতেন বলে জানিয়েছেন এক স্থানীয় বাসিন্দা।

তিনি কিছু মালিককে নামমাত্র দামে তার কাছে জমি বিক্রি করতে বলতেন এবং অন্য মালিকদের তার সশস্ত্র ক্যাডারদের দিয়ে তুলে নিয়ে আসতেন। যতক্ষণ তারা জমি বিক্রি করতে রাজি না হতেন, ততক্ষণ তাদের নির্যাতন করা হতো।

অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘স্থানীয় বাজারের যখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা দাম চলছিল, তখন চার বা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে একটি দোকানটি কিনে নেন হাজী সেলিম।’

নদী দখল

২০১৯ সালের শুরুতে হাজী সেলিমের দখল থেকে কামরাঙ্গীরচর ও ঝাওচরের বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলের প্রায় আড়াই একর জায়গা উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

এ বছরের ১৯ মে বসিলা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক অনিল বিহারী নাথ দুটি ট্রাক, একটি লোডার ও তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন ঝাওচরের আরশিনগরে বুড়িগঙ্গা নদী ভরাটের দায়ে। এই লোডার হাজী সেলিমের মালিকানাধীন আল মদিনা মেরিটাইমের মালিকানাধীন।

এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— মাসুম সৈকত, সুধাংশু কুমার সরকার ও জসিম আকান।

অনিল বিহারী নাথ কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলাও দায়ের করেছেন।

গত মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে আল মদিনা মেরিটাইম সাইটের তত্ত্বাবধায়ক সুধাংশু জানান, তারা এখন জামিনে বের হয়েছেন। তিনি দাবি করেন, তারা নদী ভরাট বা দখল করছেন না। পুলিশ ভুল করে তাদের গ্রেপ্তার করেছে।

উপপরিদর্শক অনিল গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, নদীতে বালু ভরাটের অপরাধে তিনি তিন জনকে আটক করেছিলেন।

অগ্রণী ব্যাংকের জমি উদ্ধার

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের মালিকানাধীন ১৯ দশমিক ১৪ ডেসিমাল জমিও দখল করেন হাজী সেলিম ও তার পরিবার।

গত মঙ্গলবার হাজী সেলিমের হাত থেকে জমিটি পুনরুদ্ধার করে অগ্রণী ব্যাংক।

অগ্রণী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও শাখা প্রধান বৈষ্ণব দাস মণ্ডল জানান, অগ্রণী ব্যাংক, যেটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে হাবিব ব্যাংক ছিল, গত ৭৩ বছর ধরে এই জমির মালিক।

কিন্তু, ২০০৩ সাল থেকে হাজী সেলিম জমিটির মালিকানার দাবি করছেন এবং জাল দলিল দেখিয়ে জমি দখলের চেষ্টা করেন। ব্যাংক তখন বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি করে এবং ২০১৬ সালে একটি মামলাও করে।

জমিটি নিয়ে আইনি লড়াই এখনো চলছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি চলাকালীন তারা দোতলা ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশান আরা সেলিমের বিরুদ্ধে জিডি করেছে। কাগজের হিসেবে জমিটির দাবিদার তিনিই।’

জানতে চাইলে হাজী সেলিমের পিএ সোহেল আহমেদ দাবি করেন, জমিটির আসল মালিক হাজী সেলিম এবং এটি প্রমাণ করার জন্য তাদের কাছে সব কাগজপত্রই আছে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago