শৈশবেই হারিয়ে যাচ্ছে হরিজন শিশুর ভবিষ্যৎ

ছোট থেকেই হরিজন শিশুদের ঝাড়ু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছবি: এস দিলীপ রায়

প্রিয়াংকা বাঁশফোর (৭) স্থানীয় পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা বিশ্বজিত বাঁশফোর ও মা পুতুল রানী বাঁশফোর স্থানীয় একটি বাজারে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন। থাকেন শহরের ড্রাইভারপাড়া হরিজন কলোনিতে। প্রিয়াংকা তার নানি রোজিনা বাঁশফোরের সঙ্গে প্রতিদিন সকালে শহরের রেলগেট এলাকায় রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করেন।

প্রিয়াংকা বাঁশফোরের মতো হরিজন কলোনির অধিকাংশ শিশুই তাদের বাবা-মা ও স্বজনদের সঙ্গে পরিচ্ছন্নকর্মী হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারে না। সর্বোচ্চ প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারে। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর সংখ্যা খুবই কম। শুধু সচেতনতা ও মানসিকতার অভাবে এ জনগোষ্ঠীর শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যায়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা অর্থ উপার্জনে ঝুঁকে পড়ে। একসময় হরিজন জনগোষ্ঠীর চিরাচরিত সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মূলধারার সঙ্গে আর সম্পৃক্ত হতে পারে না।

প্রিয়াংকা বাঁশফোর জনায়, সে পড়তে চায়। লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। কিন্তু পরিবারের লোকজন তাকে পরিচ্ছন্নকর্মী হতে উৎসাহ দিয়ে আসছে। জোড় করে রাস্তা ঝাড়ু দিতে শেখাচ্ছে। রাস্তা ঝাড়ু দিতে কষ্ট লাগে তার। ভোরবেলা ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় তাকে। তারপর নানীর সঙ্গে বের হতে হয়।

প্রিয়াংকার নানি রোজিনা বাঁশফোর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি আমার নাতনীকে রাস্তা ঝাড়ু দিতে শেখাচ্ছি। এটা ওর পৈতৃক পেশা। তাই ছোট থেকেই নাতনীকে এ পেশায় সম্পৃক্ত করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই আমার নাতনী লেখাপড়া করে মানুষ হোক, উন্নতি করুক। কিন্তু, আমাদের জীবনে লেখাপড়ার সুযোগ কম আসে। সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই স্বপ্ন পূরণ হয় না। তাই বাধ্য হয়েই জাত পেশার সঙ্গে শিশুদের মানিয়ে নিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’

প্রিয়াংকার বাবা বিশ্বজিত বাঁশফোর বলেন, ‘আমি আর আমার স্ত্রী পুতুল রানী বাঁশফোর স্থানীয় একটি বাজারে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করে যা আয় করি তা দিয়ে সংসার চলে না। মেয়ে প্রিয়াংকাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে লেখাপড়া করাবো বলে। পাশাপাশি জাত পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।’

বিশ্বজিত বাঁশফোর আরও বলেন, ‘দারিদ্রতার কারণে আমাদের সচেতনতা লোপ পেয়েছে। পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে সরকারি চাকরিতে আমাদের অধিকার আছে, কিন্তু আমরা সেই অধিকার বঞ্চিত। ঘুষ দিতে না পারায় আমরা সরকারি চাকরি পাচ্ছি না।’

মূলধারার মানুষ ঘুষ দিয়ে এ চাকরি নিয়ে নিচ্ছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

সরকারি চাকরিতে তারা যদি তাদের অধিকার পেতেন তাহলে তাদের ছেলে-মেয়েদের ঝাড়ুদার না বানিয়ে শিক্ষিত করার মানসিকতা হতো বলে তিনি জানান।

প্রিয়াংকার মা পুতুল রানী বাঁশফোর বলেন, ‘আমিও চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। আমার মেয়েকে স্কুল ভর্তি করেছি, কিন্তু বেশিদূর পড়াতে পারবো না। আজ হোক আর কাল হোক জাত পেশাকে কাজে লাগাতে হবে। তাই শিশু অবস্থায় মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’

লালমনিরহাট হরিজন কমিউনিটি উন্নয়ন নেতা ঘুগলু বাবু বাঁশফোর বলেন, ‘শিশুদের স্কুলমুখী করতে অভিভাবকদের সচেতনতা ও মানসিকতা বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করা হচ্ছে। আগের তুলনায় এখন অনেক সচেতনতা বেড়েছে। শিশুদের শিক্ষিত করার সুযোগ পেলে মূলধারার সঙ্গে সমগতিতে চলারও সুযোগ হবে।’

Comments

The Daily Star  | English

US starts war with Iran bombing key nuclear sites

Iran says 'no signs of contamination' after US attacks on key nuclear sites

1h ago