এক জাহাজে ৪ মহাদেশ, ৬ দেশ
এবার জাহাজে জয়েনিং ছিল আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে, আর সাইন অফ অর্থাৎ জাহাজ থেকে দেশে ফিরেছিলাম জাপানের সেন্দাই পোর্ট থেকে। প্রায় সাত মাসের ভয়েজে সুযোগ হয়েছিল আমেরিকা, পর্তুগাল, ইউকে, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ দেশ ব্রাজিল আর এশিয়ার জাপানে পা রাখার।
পানামাতে 'পা নামাতে' না পারলেও বিখ্যাত পানামা ক্যানেল দিয়ে আমেরিকা থেকে জাপানে এসেছিলাম যা আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। এক কন্ট্রাক্টে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশে গিয়েছিলাম।
সাধারণত জাহাজে জয়েনিং এর সময় সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন দিন হোটেলে রাখা হয়। কোম্পানি সবসময় চেষ্টা করে যেন ক্রুদের হোটেলে না রেখে সরাসরি জাহাজে জয়েন করানো যায়। তবুও অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জাহাজ পোর্টে আসতে দেরি করলে মেরিনারদের হোটেলে রাখা হয় সম্পূর্ণ কোম্পানির খরচে। তবে আমার ভাগ্যটা একটু বেশিই ভালো ছিল বলতে হবে।
জাহাজ পোর্টে এসেছিল আমরা (আমি, একজন টার্কিশ আর ৩ জন ইন্ডিয়ান মেরিনার) আমেরিকা পৌঁছানোর ১৬ দিন পর। ফলশ্রুতিতে আমরা ১৭তম দিনে জাহাজে জয়েন করি। আগেই বলেছি হোটেলে থাকা-খাওয়ার সব খরচ কোম্পানির। সে হিসেবে আমাদের জন্য এটা ছিল আমেরিকায় ২ সপ্তাহের 'পেইড ভ্যাকেশনের' মতো। আমেরিকায় আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকলেও স্কুল-কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধু, বড় ভাই-ভাবী থাকেন নিউইয়র্কে যাদের জন্য সেই সুন্দর দিনগুলো হৃদয়ের মনিকোঠায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ থেকে টানা ২১ ঘণ্টা ফ্লাই করে দুপুর ৩টায় হোটেলে পৌঁছে যখন শুনলাম সেদিন জয়েনিং হবে না তখন নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আমার নিউজার্সির হোটেলের ঠিকানা দিতেই স্কুলের বন্ধুরা চলে আসে। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলে ঘুরাঘুরি। এরমধ্যে বাকি বন্ধু আর পরিচিতদের সাথে দেখা করতে জ্যামাইকা, জ্যাকসন হাইটসেও গিয়েছিলাম। প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে বাংলা খাবার আর চা খেয়ে বিখ্যাত টাইম স্কয়ার দেখে হোটেলে ফিরতে প্রায় ভোর। মেরিনার হওয়ার একটা অন্যতম সুবিধা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা বন্ধু-আত্মীয়দের সাথে দেখা করার সুযোগ পাওয়া যায় মাঝেমাঝে। এর আগের ভয়েজে মালয়েশিয়া গিয়েও এক ভাতিজা আর কলেজ বন্ধুর সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল।
পরদিন এজেন্ট যখন জানালো জাহাজ পোর্টে আসেনি, জয়েনিং হবে না সেদিন গিয়েছিলাম 'হাডসন ইয়ার্ড'। জগৎবিখ্যাত 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি' একদম কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়নি শেষ ফেরি মিস করায়। লিবার্টি আইল্যান্ড যাবার ফেরিগুলো সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত মেইনল্যান্ড থেকে ছেড়ে যায়। নিউইয়র্কের একটা বড় সমস্যা হলো 'কার পার্কিং'। উপযুক্ত পার্কিংয়ের জায়গা পেতে অনেক সময় গন্তব্য থেকে ২০-২৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বেও গাড়ি পার্ক করতে হয়। আমার বন্ধু লিবার্টি আইল্যান্ড নিয়ে যেতে না পারার আফসোস মেটাতে চড়লো স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ফেরিতে যেখানে যাবার সময় ফেরিটা স্ট্যাচু অব লিবার্টির বেশ কাছ দিয়ে যায়। ফেরিতে থাকা এক ট্যুরিস্ট আমাদের সুন্দর একটা ছবিও তুলে দিয়েছিল স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে পেছনে রেখে। যদিও তখন জানতাম না, পরে জেনেছিলাম যে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ফেরির চিফ ইঞ্জিনিয়ার একজন বাংলাদেশি, যিনি আমাদের বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ২৫তম ব্যাচের একজন এক্স-ক্যাডেট। সেদিন স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ছাড়াও দেখেছিলাম 'কাল হো না হো' গানে দেখানো 'চার্জিং বুল', রাতের ম্যানহাটন আর ব্রুকলিন ব্রিজ।
এভাবে বাকি দিনগুলোতে বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত খাওয়া ছাড়াও গিয়েছিলাম কুইন্স মল, রুজভেল্ট আইল্যান্ড, ইন্ট্রেপিড মিউজিয়াম, সেন্ট্রাল পার্ক, গ্যান্ট্রি প্লাজা স্টেইট পার্ক, লং আইল্যান্ড বিচ। ১৯০৪ সালে চালু হওয়া স্টেশন সংখ্যার ভিত্তিতে (৪৭২টি) পৃথিবীর সবচেয়ে বড় র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম নিউইয়র্ক সাবওয়েতে যাতায়াতেরও সুযোগ হয়েছিল। নিউইয়র্কের মতো জায়গায় 'ফুচকা' বিক্রি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। দামটাও কম না, ৭টা ফুচকা খেয়েছিলাম ৬ ডলার দিয়ে! টাকার হিসেব করলে নিউইয়র্কের একটা ফুচকা সমান বাংলাদেশের প্রায় দুই প্লেট ফুচকা। জ্যাকসন হাইটসে বাংলায় হাতে লেখা 'রুমমেট আবশ্যক' দেখেও কম অবাক হইনি।
সাথে থাকা ইন্ডিয়ান তিন জন আমার বন্ধুদের আন্তরিকতায় খুবই অবাক হয়েছিল। কিছুদিন পর ওরা হোটেলে শুয়ে-বসে বোর হলেও আমাকে ঘুরানোর জন্য প্রতিদিনই কোন না কোন বন্ধু গাড়ি নিয়ে হাজির হতো হোটেলে। কোম্পানি থেকে খাবারের জন্য বরাদ্দকৃত দৈনিক ৭৫ ডলারের ফুড ভাউচার সাথের ক্রুদেরই দিয়ে দিতাম বেশিরভাগ দিন। এক ইন্ডিয়ান বললো, উনার আমেরিকা থাকা এক বন্ধুকে অনুরোধ করেছিল দেখা করতে কিন্তু সে আসতে পারবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। বলেছে ইন্ডিয়া গেলে দেখা করবে। নিজেকে তখন বাংলাদেশি হিসেবে খুবই গর্ব হচ্ছিল, কেননা আমাদের দেশের মতো এমন আন্তরিক আর অতিথিপরায়ন জাতি খুব কমই আছে।
নিউইয়র্ক থেকে সেইল করে গিয়েছিলাম আমেরিকার নিউ অরলিন্স। দেখেছি নর্থ আমেরিকার দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী 'মিসিসিপি'। প্রায় ১৮ ঘণ্টা মিসিসিপি নদীর মধ্য দিয়ে জাহাজ চলার পর পোর্টে পৌঁছেছিলাম।
নিউ অরলিন্স থেকে গিয়েছিলাম ইউরোপের পর্তুগাল। সেখান থেকে ইউকের পেমব্রোক। পেমব্রোকে ঘুরে বেড়ানোর সময় কথায় কথায় এক ব্রিটিশ বললো, এখানে কাছেই খুব ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে, ‘চাটনি’, যার মালিক বাংলাদেশি! আমার সাথে থাকা কলকাতার চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর মুম্বাইয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারও বললো, 'চাটনি'তেই যাবে ডিনার করতে। সেখানে সন্ধ্যাবেলাতেই পুরো রাস্তা ফাঁকা, লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এরমধ্যে আমরা তিনজন একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, ফাঁকা রাস্তা ঘুরে ঘুরে খুঁজে পেলাম সেই রেস্টুরেন্ট। ভেতরে ঢুকেই পেয়েছিলাম সিলেটের ফয়জুল বারী ভাইকে।
খাবার আসার পর দেখলাম, সবার প্লেটে প্রায় দুজনের সমপরিমান খাবার! খাবারের টেস্ট আর পরিমাণ দেখে চিফ আর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারও অনেক খুশি। বহুকষ্টে এত খাবার শেষ করে বিদায় নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম নরমালি খাবারের পরিমাণ এতো বেশি দেয় কিনা। জবাবটা ছিল মনে রাখার মতো। বললো, ‘আপনি আপনার রেস্টুরেন্টে ভিনদেশি দুজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন। তারা তো আমাদেরও গেস্ট! সেজন্য আপনাদের সব বেশি করে দিয়েছি। সাদারা তো খায় খুবই অল্প, আপনাদের যা দিয়েছি তার অর্ধেক।’ উনার ভাবনা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল। আমার রেস্টুরেন্ট, আমার গেস্ট কিন্তু আপ্যায়নের পুরো দায়িত্বটা নিলেন উনি!
ওদিকে বিল রাখার সময়ও প্রায় ৫ পাউন্ড কম রেখেছিলেন বারী ভাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ব্রিটিশ পাসপোর্ট নয় বাংলাদেশই উনাদের শিখিয়েছে এই আন্তরিকতা আর আতিথেয়তা। ব্রিটেনে এসে সত্যি স্মৃতিসৌধের দেখা না পেলেও চাটনি'র দেয়ালে দেখেছিলাম খুব সুন্দর একটা স্মৃতিসৌধের ছবি যার মধ্যে ছিল বাংলাদেশের পতাকা আর যেখানে কাজ করছিল কিছু প্রকৃত হৃদয়ের বাংলাদেশিরা।
ইউকে থেকে আবার আমেরিকার নিউইয়র্ক, এরপর টেক্সাসের গ্যালভেস্টন থেকে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। ব্রাজিলের প্যারানাগুয়াতে পা রেখে মনুষ্য বসবাস উপযোগী ছয় মহাদেশে পদার্পণ করার সৌভাগ্য অর্জন করি।
ব্রাজিল থেকে এবার আমেরিকার হিউস্টন। সেখানে দেখা করতে ডালাস থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা ড্রাইভ করে কলেজের এক বন্ধু এসেছিল। দুজনে গিয়েছিলাম হিউস্টনের 'নাসা স্পেস সেন্টার'। ওয়ালমার্ট থেকে কিছু কেনাকাটা করে ডিনার শেষে প্রায় মধ্যরাতে ফিরেছিলাম জাহাজে। এরপর আমেরিকা থেকে পানামা হয়ে ৩৫ দিনের লম্বা ভয়েজ শেষে জাপান পৌঁছেছিলাম। জাপানের সেন্দাই পোর্ট থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিলাম ৭ মাস ২ দিন পর।
বর্তমানে বাংলাদেশি মেরিনারদের বিশেষ করে জুনিয়র অফিসারদের চাকরির বাজার খুবই খারাপ। তা না হলে মেরিনের মতো এমন চমৎকার পেশা খুব কমই আছে বলা যায়। শতভাগ হালালভাবে উপার্জনের পাশাপাশি এমন বিশ্বভ্রমণের সুযোগ আর কয়টা পেশায় আছে!
লেখক: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ, এক্স-ক্যাডেট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি (৪৭তম ব্যাচ)
Comments