বৈবাহিক ধর্ষণে কিশোরীর মৃত্যু: এরপরও কেন এটি বৈধ?
গত ২৫ অক্টোবর টাঙ্গাইল থেকে আসা ১৪ বছরের এক কিশোরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য মতে, তার মৃত্যুর কারণ ছিল যোনিপথে অত্যধিক রক্তক্ষরণ।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীর নাম নূরনাহার। টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাউলজানি ইউনিয়নের কালিয়া গ্রামের মেয়ে নূরনাহার কালিয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। নূরনাহারের পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই ছিল। তার বাবা-মা দুই জনেই দিনমজুর হিসেবে সারাদিন কাজ করেন। দিনমজুরির কাজে দিনের বড় একটা সময় তারা বাসার বাইরে থাকতেন। বাড়িতে থাকার সময়টুকু কাটত কলহে। এমন পরিবেশ থেকে নূরনাহারকে দূরে রাখার জন্য মাত্র চার বছর বয়সে তার নানা লাল খান তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। নূরনাহার তার নানার কাছেই মানুষ হচ্ছিল। লাল খানই নূরনাহারকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। দিনমজুর হিসেবে পাওয়া সামান্য উপার্জন থেকে নাতনির লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ চালাতেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে নূরনাহারের সুনাম ছিল। বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সে এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিল।
কিন্তু বিধি বাম। করোনার আঘাতে লাল খানের ছোট্ট সংসার পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় গত ২০ সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী গ্রামের ৩৪/৩৫ বছরের রাজিব খানের সঙ্গে নূরনাহারের বাল্যবিয়ে হয়। অভিবাসী শ্রমিক রাজিব আরব আমিরাতে কাজ করেন। ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। রাজিব ভালো উপার্জন করেন, এমন কথার ভিত্তিতে নূরনাহারের পরিবার রাজিবের সঙ্গে মেয়েকে বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়। লাল খান ৩০ হাজার টাকা খরচ করে নাতনির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’র বিধান অনুযায়ী, নূরনাহারের বয়স বিবাহযোগ্য না হওয়ায় (১৮ বছর) উভয় পরিবার বিয়ে নিবন্ধন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের পর নূরনাহার বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়।
একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লাল খান বলেন, ‘আমার নাতনি আমাকে খবর দেয় যে, বিয়ের প্রথম রাত থেকেই তার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।’ রাজিব তার নববধূর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা তো করেননি, বরং মেয়েটির গভীর ক্ষতকে উপেক্ষা করে তিনি সহবাস চালিয়ে যান। রক্তপাত না থামায় নূরনাহারের শাশুড়ি তাকে স্থানীয় কবিরাজি দাওয়াই এনে খাওয়ান। পরবর্তীতে নূরনাহারের অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ২২ অক্টোবর টাঙ্গাইলের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে তাকে নেওয়া হয় এবং সুকৌশলে পুত্রবধূর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বাপের বাড়ির লোকের ওপর বুঝিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চলে যান।
অবস্থার অবনতিতে মেয়েটিকে তারপর মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসার খরচ মেটাতে নূরনাহারের পরিবার হিমশিম খাচ্ছিল। তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে ৬০ হাজার টাকা জোগাড় করে পরিবারের হাতে তুলে দেয়। শেষ পর্যন্ত নূরনাহারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আনা নয়। কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ২৫ অক্টোবর নূরনাহার পরাজয় স্বীকার করে। পরের দিন ময়নাতদন্ত শেষে নানাবাড়ির নিকটবর্তী স্থানীয় গোরস্থানে তার দাফনকার্য সম্পাদিত হয়। লাল খান তার নাতনির মৃত্যুর জন্য রাজিবকে দায়ী করেছেন। রাজীব তার সদ্যমৃত স্ত্রীর জানাজায় পর্যন্ত যাননি।
নূরনাহারের শাশুড়ি বিলকিস বেগমের বক্তব্য, ‘নূরনাহারকে জিনে ধরেছিল। তাই তার যোনিপথে এত রক্তক্ষরণ হয়েছে।’ বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফিরোজুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, মেয়েদের প্রথম মিলনের ক্ষেত্রে ভয় ও আতঙ্ক বোধ করা খুবই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, অপরিণত বয়সে বিয়ে হলে যোনিপথে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য বিলম্ব না করে গাইনোকোলজিস্ট দেখানো জরুরি।
গ্রাম্য সালিশে নূরনাহারের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টাকা দিয়ে বিষয়টি ‘মিটমাট’ করে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে, জানা গিয়েছে যে, নূরনাহারের পরিবার বাসাইল থানায় শ্বশুরবাড়ির নামে অভিযোগ দাখিল করেছেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য যে, বাল্যবিবাহ সংঘটনের মাধ্যমে নূরনাহারের পরিবারের লোকেরাও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’র ৮ ধারা অনুযায়ী অপরাধী। যার জন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত করা যায়।
নূরনাহারের পরিবারের একটিবারও মনে হয়নি যে, নূরনাহারের মতো একজন মেধাবী শিক্ষার্থী একদিন তাদের দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি এনে দেবে। তাদের কাছে মোটা টাকা কামানো প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাই বড় ছিল। অথচ নূরনাহারের নানা কিনা নিজ উদ্যোগে নাতনিকে স্কুলে পড়াচ্ছিলেন! আজও এ সমাজে মেয়ের বিয়ের কাছে তাদের লেখাপড়া, তাদের স্বনির্ভরতা, তাদের দক্ষতা অর্জন হেরে যাচ্ছে।
একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া জরুরি যে, নূরনাহার মারা গেছে তার বরের জবরদস্তিমূলক উপর্যুপরি সঙ্গমের কারণে। কিন্তু, দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের আইনে ১৩ বছরের বেশি বয়সের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস ধর্ষণ বলে বিবেচিত না। রাজিবের এই পাশবিকতা আমাদের দণ্ডবিধি ১৮৬০’র ৩৭৫ ধারায় (যে ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে) অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। উপরন্তু, দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী (যেখানে ধর্ষণের শাস্তি বর্ণিত হয়েছে) বৈবাহিক ধর্ষণের শাস্তি কেবল তখনই দেওয়া যেতে পারে, যখন স্ত্রীর বয়স ১২ বছরের কম হবে এবং সেই শাস্তির পরিমাণ মাত্র অনূর্ধ্ব দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা।
এই আইনগুলো আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা। ঔপনিবেশিক শাসনকালে যখন ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান, তখন এই আইনের সৃষ্টি। ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতায় স্ত্রীকে তার ‘স্বামী’ অর্থাৎ মালিকের সহধর্মিণী না, বরং সম্পত্তি ভাবা হতো। সেই সমাজে নিজের স্ত্রীকে যথেচ্ছা ভোগ করার জন্য পুরুষকে দায়বদ্ধ করা ছিল অকল্পনীয়। এমন একটি রক্ষণশীল ধর্ষণের সংজ্ঞা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো আজও আগলে রেখেছি।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরোধের জন্য এই পর্যন্ত তিন বার বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। প্রথমে ১৯৮৩ সালে, এরপর ১৯৯৫ এবং সর্বশেষ ২০০০ সালে। কিন্তু, প্রতিবারই আমাদের আইন প্রণেতারা সজ্ঞানে দণ্ডবিধি থেকে বৈবাহিক ধর্ষণের দায়মুক্তি দেওয়া ওই ব্যতিক্রম ধারা বাতিলের পরিবর্তে বহাল রেখেছেন। এই আইনের হোতা যেই ব্রিটিশ, তারা কিন্তু সেই ১৯৯১ সালেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তান (দেশভাগের পর ওই আইন পাকিস্তানেও বলবত ছিল) ২০০৬ সালে বৈবাহিক ধর্ষণের ওই ব্যতিক্রম ধারা বাতিল করেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত জাতীয় জরিপের (২০১৫ সাল) তথ্য অনুযায়ী, বিবাহিত নারীদের ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ তাদের বৈবাহিক জীবনে স্বামীর কাছে জবরদস্তিমূলক সহবাসের পাশাপাশি অন্যান্য যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া ১৯ হাজার ৯৮৭ জন নারীর মধ্যে পাঁচ হাজার ৩৯০ জন নারী বলেছেন, তাদের স্বামী তাদের ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণের ব্যতিক্রম ধারা বহাল রেখে আমরা এই নারীদের কী বার্তা দিচ্ছি?
আমরা বলছি যে, হাজারো নারী ও কিশোরী যারা নিঃসন্দেহে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ও হচ্ছেন, তাদের বিচার চাওয়ার কোনো অধিকার নেই। আমাদের আইন আমাদের শেখাচ্ছে যে নারী আসলে তার স্বামীর সম্পত্তি। আমরা বলছি যে, কাবিননামায় সই করে বা কবুল বলে বা মন্ত্রপাঠে সাত পাঁকে বাঁধা পড়ে একজন নারী অনন্তকালের জন্য যৌন সম্পর্কের সম্মতি দিয়ে দিচ্ছেন। এ সম্মতি কখনো ফেরত নেওয়া যাবে না। নারীর শরীর খারাপ থাকুক, মর্জি না থাকুক, পরিবেশ না থাকুক, বর ‘চাহিবামাত্র’ নারীকে সহবাস করতেই হবে। তাকে রাজি হতে হবে না। তার রাজি-খুশি নিয়ে আইন চিন্তিত নয়। আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে, নূরনাহারের মতো বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া কিশোরীরা যখন জবরদস্তিমূলক যৌনসঙ্গমে মারা যাচ্ছে, সেই জবরদস্তিমূলক সহবাস আসলে ধর্ষণ না, কেবল এ কারণে যে ওই পুরুষটি মেয়েটির ‘স্বামী’। জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। তারপর জোর করে সহবাস করা হবে। কিন্তু নারী ‘না’ বলতে পারবে না।
রাজিব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের এখন যেই এক অপরাধের জন্য দায়ী করা যাবে, তা হলো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ৭ নম্বর ধারার অধীনে বাল্যবিবাহ করার অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা। তবে, শাস্তি শুধু জরিমানাও হতে পারে। কাজেই, কোনো পুরুষ যদি মনে করে যে, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে তিনি বৈধ উপায়ে প্রতি রাতে একটি বাচ্চা মেয়েকে সবরকম দায়মুক্তভাবে ভোগ (ধর্ষণ) করবে, তাহলে অন্তত আইনত তার সিদ্ধান্ত সঠিক। আমাদের সমাজে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামানোর মতো মেয়ের সংখ্যা তো কম নয়! কোনো থানা বা আদালতও বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ নিতে পারবে না, ইচ্ছা থাকলেও।
এটাই আমাদের আইন। এটাই আমাদের বাস্তবতা। আমাদের জানতে হবে। আমাদের ঘৃণা করতে হবে। আমাদের আপত্তি জানাতে হবে।
তাকবির হুদা, বাংলাদেশ লিগ্যাল অ্যাইড ও সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) গবেষণা বিশেষজ্ঞ
অর্পিতা শামস মিজান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments