‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ রোবোটিক্স প্রতিযোগিতা ২০২০

১৭৩ দেশকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন যারা, কেমন তারা!

তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্যে বিশ্বের ১৭৩টি দেশকে হারাতে হয়েছে। ১৭৪টি দেশের অংশগ্রহণে ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ রোবোটিক্স প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম বাংলাদেশ। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের অবিশ্বাস্য এই গৌরব বাংলাদেশের মুখ আলোকিত করেছে বিশ্বমঞ্চে!
‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ রোবোটিক্স প্রতিযোগিতা ২০২০-এর টিম বাংলাদেশ। (প্রথম সারিতে বাম থেকে) আবরার জাওয়াদ, জাহরা চৌধুরী, বিয়াঙ্কা হাসান, আরিবাহ আনোয়ার, আয়মান রহমান, (দ্বিতীয় সারিতে বাম থেকে) ফাইরুজ হাফিজ ফারিন, শাহরিয়ার সেমন্তো, রাজীন আলী, সুজয় মাহমুদ, মাহি জারিফ, (নিচের সারিতে বাম থেকে) মেন্টর শামস জাবের, টেকনিক্যাল মেন্টর শোয়েব মির্জা, অ্যাসিস্ট্যান্ট মেন্টর ফারদিন অনন্ত এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট মেন্টর নম্রত রায়। ছবি: সংগৃহীত

তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্যে বিশ্বের ১৭৩টি দেশকে হারাতে হয়েছে। ১৭৪টি দেশের অংশগ্রহণে ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ রোবোটিক্স প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম বাংলাদেশ। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের অবিশ্বাস্য এই গৌরব বাংলাদেশের মুখ আলোকিত করেছে বিশ্বমঞ্চে!

তারা কারা,কীভাবে এই অসাধ্য সাধিত হলো?

ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের খেলনা গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স রোবট ভেঙে ভেতরে কী আছে দেখত আয়মান। ছেলের আগ্রহ দেখে বাবা-মা তাকে ইউটিউবে মেশিন কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে ভিডিও দেখাতে শুরু করে। নয় বছর বয়স থেকে রোবোটিকস, ইলেকট্রনিক্স বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানতে ও শিখতে টেক একাডেমিতে ভর্তি হয় আয়মান।

দ্য ডেইলি স্টারকে আয়মান বলেন, ‘ইন্টারনেট ঘেঁটে কীভাবে রোবট বানাতে হয়, মেশিন কীভাবে কাজ করে এসব নিয়ে আমি নিজে থেকেই শিখতে শুরু করি।’

হাইস্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় রোবোটিক্স প্রতিযোগিতা ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ এ ১৭৪টি দেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টিম বাংলাদেশ।

টিম বাংলাদেশ এর সদস্য ১৫ বছর বয়সী আয়মান রহমান জানায়, ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জের একটি ধাপ ছিল “কোয়ারেন্টিন চ্যালেঞ্জ”। কোয়ারেন্টিনে কে কী করেছে সেটি দেখাতে হতো। আমি কোয়ারেন্টিনে একটি রোবট বানিয়েছিলাম। এটা ওয়াইফাই দিয়ে কন্ট্রোল করা যায়, সঙ্গে একটা ক্যামেরাও আছে। রোবটটার নাম দিয়েছিলাম “কোভিট্রন ওয়ান”।

কোভিড রোগীর কাছে এই রোবট খাবার, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেবে, যাতে অন্য কেউ সংক্রমণের ঝুঁকিতে না পড়ে। আমার এই প্রজেক্টটি সবার কাছেই  প্রশংসিত হয়। সেরা ১০ প্রজেক্টের মধ্যে “কোভিট্রন ওয়ান” কে রাখা হয়।’

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম বা স্টেম) এই চারটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে প্রতি বছর ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ আয়োজিত হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে তরুণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় বলে আয়োজনটি ‘রোবোটিক্সের অলিম্পিক’ হিসেবেও পরিচিত। এর ফরম্যাটটাও অনেকটা অলিম্পিকের মতোই।

শুধু একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়, ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে অন্যদের সহযোগিতা করলেও পাওয়া যায় বোনাস পয়েন্ট।

সুজয় মাহমুদ (১৭) জানায়, ‘সাধারণত প্রতিযোগিতাটা হয় তিনটি টিম ভার্সেস টিমে। ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ এর বিষয়টিই হলো ‘কম্পিটিশন এবং কোঅপারেশন’। এখানে অন্য টিমকে সহযোগিতা করতে হয়, উৎসাহও দিতে হয়।

‘রোবোটিক্সের অলিম্পিক’ এ অংশগ্রহণকারীদের তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে- সোশ্যাল মিডিয়া চ্যালেঞ্জ, টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ আর স্টেম টকস।

সুজয় জানায়, ‘সোশ্যাল মিডিয়া চ্যালেঞ্জে মূলত সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কিছু কাজ করতে হয়েছে। আমাদেরকে স্টেম নিয়ে গানও লিখতে হয়েছে। সেটার মিউজিক ভিডিও বানিয়েছি।

“ট্যাং টুইস্টার” চ্যালেঞ্জে সফটওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে নিজের ভাষায় সবচেয়ে অদ্ভুত বাক্যটি শোনাতে হয়েছে। আমরা ‘পাখি পাকা পেপে খায়’ বাক্যটি নিয়ে এটি করেছিলাম। এভাবেই বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে নিজ দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার পাশাপাশি অন্য দেশের সংস্কৃতির ব্যাপারেও জানতে পেরেছি।’

প্রতিযোগিতায় টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ ক্যাটাগরিতেই মূলত রোবোটিক্স বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতা যাচাই করা হয়। এই টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জেই অন্য সব দেশকে পেছনে ফেলে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে জায়গা করে নেয় টিম বাংলাদেশ।

সুজয় জানায়, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বা টকসে আমাদের কয়েকটা টাস্কে পয়েন্ট কম হলেও টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জে আমরা অনেক ভালো করেছি। তাই সবমিলিয়ে আমরা শীর্ষে চলে আসি।’

‘টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জে আমাদের পাঁচ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমে ছিল একটি পেপার প্লেইন লঞ্চার বানানো, এরপর বল মুভমেন্টের চ্যালেঞ্জ ছিল, ঘর পরিষ্কার করবে এরকম রোবটের ক্যাট আমরা ডিজাইন করেছি, সর্বশেষ আমরা এমন একটা ডিভাইস ডিজাইন করেছি যেটা দিয়ে একটা সমস্যা দূর করা যাবে। বাংলাদেশে এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুমৃত্যুর একটা কারণ হলো পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। আমরা একটি নেকলেস বা তাবিজ টাইপের ডিভাইস বানিয়েছি। সেটা যদি গলায় পরে থাকে তাহলে পানির সংস্পর্শে আসার পর ওটা থেকে একটা এয়ার ব্যাগ খুলে যাবে৷ যার মাধ্যমে ওই শিশু বেঁচে যাবে। প্রত্যেকটিতেই আমরা সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়েছি।’

তিন মাস ধরে চলা এই প্রতিযোগিতায় অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে দিন রাত জেগে কাজ করার কথা জানিয়েছে টিম বাংলাদেশ এর আরেক সদস্য জাহরা চৌধুরী (১৪)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথাও জানায়।

জাহরা জানায়, ‘কাজ জমা দেওয়ায় শেষ সময় বাংলাদেশের ঘড়িতে সকাল ৬টা। তো দেখা গেছে সারারাত জেগেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। শেষদিনও আমরা রাত জেগে কাজ করেছি। সেদিন আমার জন্মদিন ছিল। এই বছরের জন্মদিন একেবারেই অন্যরকম কেটেছে।’

গত তিন মাসের যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলে টিম বাংলাদেশের আরেক সদস্য বিয়াঙ্কা হাসান (১৯) জানান, ‘শুরুতে আমরা ১৭৪টি দেশের মধ্যে ১১-১২তম অবস্থানে ছিলাম। এরপর এক সপ্তাহে একটা টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জে আমরা ফুল পয়েন্ট পাই। ওটা দেখে আমাদের মনে হলো যে, আমরা আসলেই জিততে পারব। এরপর কিছুদিন আমরা শীর্ষে থাকি, কিছুদিন অন্য দেশ আমাদের ছাড়িয়ে উপরে উঠে যায়। আমরা নিজেরা সবসময় সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করেছি।’

অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের কথা বলতে গিয়ে বিয়াঙ্কা জানান, ‘চীনের টিমটা ছিল একটু অন্যরকম, সেখানে সব নারী শিক্ষার্থীরা ছিল। ওরা খুব ভালো করেছে। টিম ওমানও খুব ভালো করেছে। ওমানের ভিডিওগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে যে ওদের সৃজনশীলতা খুব ভালো।’

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতার প্রথম আসর বসে। ২০১৮ সালে মেক্সিকোতে দ্বিতীয় আসর ও ২০১৯ সালে তৃতীয় আসর বসে দুবাইয়ে। গত বছর দুবাইয়ে প্রতিযোগিতায় তৃতীয় আয়োজনে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে ছিল।

টিম বাংলাদেশ এর ১০ জনই টেক একাডেমির তত্ত্বাবধানে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

টেক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও টিম বাংলাদেশের চিফ মেন্টর শামস জাবের দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০১৭ সালে ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। সে বছরই আমরা ‘টিম বাংলাদেশ’ তৈরি করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। টিম ইজরায়েল, আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া- এরা প্রথম বছর থেকেই অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। আমরা যখন প্রথম যাই তখন তেমনটা শক্তিশালী ছিলাম না। দেখা গেছে, আমরা শুধু কোডিং পারছি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দিক থেকে রোবোটিক্স, ইলেকট্রনিক্স এ বিষয়গুলো তখন আমরা জানতাম না। আমরা প্রথম বছর গিয়েই বুঝলাম যে আমরা আসলে খুব বেশি শক্তিশালী না। আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লেগেছে।’

চ্যাম্পিয়ন টিম বাংলাদেশ। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর করোনার কারণে পুরো প্রতিযোগিতা অনলাইনে হয়েছে। কিন্তু আগের বছরগুলোতে টিম মেম্বারদের নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ধরনের জটিলতা থাকে। আর রোবট বানানোর জন্য রোবটিক্সের যে পার্টসগুলো নিয়ে আসছি সেটা কাস্টমস এ অনুমোদন করানো, ঠিকমতো বের করে আনা, সেটাকে নিয়ে আবার যাতায়াত করা, বিদেশে যাওয়া- এটা একটা বেশ কঠিন কাজ।’

টেক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, কাঠামো পরিবর্তন করা। এখন অনেক শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হচ্ছে। স্কুল থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, শিক্ষকরাও আগ্রহী হচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গেই আমরা কাজ করতে চাই। স্টেম আর রোবোটিক্সে যেন মানুষকে আগ্রহী করে তোলা যায়, দক্ষতা বাড়ানো যায় সেজন্য আমরা চাই বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম সবখানেই এটি পৌঁছে যাবে। আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীরা আছে কিন্তু যথেষ্ট প্ল্যাটফর্ম নেই।’

আরও পড়ুন: রোবোটিক্সের অলিম্পিক ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে’ চ্যাম্পিয়ন টিম বাংলাদেশ

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago