এলোমেলো সরকারি ব্যপস্থাপনা, বহুমাত্রিক সংকটে অভিবাসী শ্রমিক
করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকেই সংকটে পড়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি ও কার্যকরী ব্যবস্থা না নেওয়ায় অভিবাসী শ্রমিকরা বহুমাত্রিক সংকটে পড়েছেন।
এই বছরের শুরুর দিকে কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিক, বিশেষত উপসাগরীয় ও আরব দেশে থাকা শ্রমিকরা ছুটির সময়ে দেশে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে মহামারির কারণে দেশে আটকে গেছেন।
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে শ্রমিকদের স্বাচ্ছন্দ্যে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত পরিকল্পনা করেনি। ফলে, সৌদি আরব স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিসার মেয়াদ বাড়ানো বন্ধ করে ফ্লাইট চলাচল চালু করলে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এন্ট্রি ভিসা ও আবাসনের অনুমতি নিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দুর্ভোগে পড়েন।
উড়োজাহাজের টিকিট, ভিসা ও ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর দাবিতে তারা রাস্তায় নামেন। পরে সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বৈঠকে বসে।
অন্যদিকে, মহামারির মধ্যে বিদেশে চাকরি হারানো প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ঋণ দিতে এপ্রিলে নেওয়া সরকারি উদ্যোগ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে।
শ্রম মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রণালয় ও অ্যাজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টার যে অনুপস্থিতি, এর পেছনে সরকারের দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কার্যকরী ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অভিবাসী শ্রমিকদের সংকট আরও গভীর হতে পারে। কারণ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সূত্রে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানায়, মহামারির আগে এই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছেন।
তাদের অধিকাংশেরই ছুটি শেষে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তারা আটকে যান।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে কিছু দেশ যখন বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল পুনরায় শুরু করে, ততদিনে অনেক শ্রমিকেরই ভিসার বৈধতা ও আবাসন অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
নেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা
বিশিষ্ট অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সি আর আবরার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা জানতাম যে এই মানুষগুলোকে ফিরে যেতে হবে। তবুও তাদেরকে ফেরানোর জন্য আমাদের দিক থেকে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু, আমরা প্রবাসীদের কাজে ফেরাতে কতটুকু ব্যবস্থা নিয়েছি? অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা চালিয়েছি? বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং পররাষ্ট্র— মন্ত্রণালয়গুলোর নীতিমালার মধ্যে কতটুকু সংগতি ছিল?’
তার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে যোগাযোগের ঘাটতি ছিল।
সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, যেমন: সব বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও যাত্রীদের জন্য ফি হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা, এগুলো যথাযথ পরিকল্পনা ও কৌশল ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে, শ্রমিকরা অযথা হয়রানি ও শোষণের মুখোমুখি হয়েছেন।’
জুলাইয়ের প্রথমদিকে, সৌদি আরব মেয়াদোত্তীর্ণ ইকামার বৈধতার মেয়াদ তিন মাসের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং দেশটির বাইরে থাকা প্রবাসীদের যাতায়াত ও রি-এন্ট্রি ভিসার অনুমোদন দেয়।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, আটকে পড়া অভিবাসী বিশেষত যারা সৌদি আরবে ফিরে যেতে চাইছেন তাদের সংকট মোকাবিলায় অন্যতম বাধা ছিল সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব।
তিনি বলেন, ‘কতজন অভিবাসী কর্মী ছুটিতে বাড়ি এসেছিল ও কতজন আটকা পড়েছে— এসব তথ্য যদি এপ্রিলের প্রথম দিকে তৈরি করা হতো, তবে বিষয়টি আরও সহজ হতো।’
তিনি জানান, যারা বছরের শুরুতে ছুটিতে এসে আটকে গেছেন, তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কারণ, তাদের নিয়ে কোনো আলোচনা, পরিকল্পনাও হয়নি।
তিনি জানান, শ্রমিকদের ভিসা ও ইকামার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। যদি আমরা আগে এটি করতে পারতাম, তবে (শ্রমিকদের) কম দুর্ভোগে পড়তে হতো।
অভিবাসী শ্রমিকদের অবদানকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছর অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স ১৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
১৬০টিরও বেশি দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি বাস করেন।
বিএমইটি’র তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত চাকরির জন্য বিদেশে থাকা অভিবাসীর মধ্যে ৭৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছয়টি উপসাগরীয় দেশ— সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার ও বাহরাইনে গেছেন।
ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা
প্রবাসীদের কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে ২২ হাজার ৯৩৬ জন নারীসহ প্রায় ২ দশমিক ০৯ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন।
গত ৫ এপ্রিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর কর্মস্থলে ফিরতে আগ্রহীদের সহায়তার জন্য ঋণ দেওয়ার একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের পর মন্ত্রণালয় ২০০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করে এবং ফিরে আসা অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাথমিকভাবে গাইডলাইনটি ‘জটিল’ হওয়ায় এটি শ্রমিকদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
পরে ১৭ সেপ্টেম্বর সরকার কয়েক দফায় সংশোধনের পর একটি নতুন গাইডলাইন প্রকাশ করে।
আগের গাইডলাইনে কোনো প্রকল্পের জন্য ঋণ পেতে হলে তাকে এক বছরের আয় এবং ব্যয়ের বিবরণ জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। পরে এই বাধ্যবাধকতা সরানো হয়েছে।
এখনো কয়েকটি বাধ্যবাধকতার জন্য অনেকেই ফরম পূরণ করতে অসুবিধায় ভোগেন। যেমন: কোনো ফেরত আসা প্রবাসী স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে ৫০ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার জন্য তাকে সম্পত্তির মালিকানার বিবরণী অথবা ভাড়া দেওয়ার নথি জমা দিতে হয়।
২১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ঋণ বিতরণ শুরু করে। তারা ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৪০০টি আবেদন পেয়েছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকার ৬০টির মতো ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল জানান, আগের গাইডলাইনটি ‘জটিল ও যথাযথ পর্যবেক্ষণ ছাড়াই প্রস্তুত’ করা হয় এবং অভিবাসী অধিকারকর্মীদের প্রতিবাদের পরে গাইডলাইনটি সংশোধন করা হয়েছিল।
তিনি জানান, দরিদ্র অভিবাসীদের কেবল ঋণ দিয়ে খুব বেশি সহায়তা করা যাবে না। অনেক অভিবাসী আগে থেকেই ঋণের বোঝা সামলাচ্ছেন এবং তারা গত সাত থেকে আট মাস ধরে কোনো আয়ও করতে পারেননি।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন শাখা) মো. শহিদুল আলম জানান, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে অর্থের যোগান দিয়েছিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ব্যাংক তুলনামূলকভাবে নতুন হওয়ার কারণে ঋণ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবলের অভাব ছিল।
তিনি জানান, নীতিমালায় পরিবর্তন আনার পর সম্প্রতি ঋণ বিতরণ বেড়েছে।
এ ছাড়াও, ‘সরকারের পদক্ষেপের কারণে’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, এক ডজনেরও বেশি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক ছাড়াও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখেছিলেন, যাতে সুযোগ পেলে তারা আটকে পড়া অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে পারে।
সংকট মোকাবিলায় যা করা যেতে পারে
বিদেশে যেতে আগ্রহী যাদের নথিপত্র করোনার কারণে মেয়াদোর্ত্তীণ হয়ে গেছে এবং নতুন করে নথিপত্র জমা দিতে বলার কারণে যারা সমস্যায় পড়েছেন, তাদের জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সৌদি আরব ২৫ হাজার নতুন ভিসা দেবে। ফলে এই সম্ভাব্য অভিবাসীদের আবার তাদের চিকিত্সা পরীক্ষা করতে হবে, নতুন পুলিশ ছাড়পত্র, প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করতে হবে ও তাদের সম্ভাব্য সৌদি নিয়োগকারীদের কাছ থেকে নতুন করে অনুমোদন নিতে হবে।
শরিফুল হাসান বলেন, ‘উদ্বেগজনকভাবে অনেক সৌদি নিয়োগকর্তা কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে শ্রমিকদের নিয়োগ নাও করতে পারেন। যা একটি নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।’
তিনি জানান, বিদেশে চাকরি পেতে ব্যর্থ হলে এই কর্মীরা কীভাবে তাদের অর্থ ফেরত পাবেন, সে বিষয়ে একটি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিদেশে থাকা এক কোটি বাংলাদেশিদের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে তাদেরকে দেশে ফিরতে না হয়।’
যারা বিদেশে আছেন বা যারা নতুন কর্মসংস্থান খুঁজছেন এবং যারা দেশে ফিরে এসেছেন— এদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে যদি আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের জন্য আলাদা ও কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে সমস্যাগুলো অনেকাংশে সমাধান করা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
Comments