ভুয়া দলিলে পানজুম দখল, অস্তিত্ব সংকটে খাসিয়া পরিবার
একটি খাসিয়া পরিবারের প্রথাগত জমি জোরপূর্বক দখল করে পান নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি ওই জমিতে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ারও অভিযোগ তোলা হয়েছে। একমাত্র আয়ের উৎস এই পানজুমটি দিয়ে পরিবারের কর্তার ক্যান্সার চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ চালাতো ওই পরিবার। যার দুটিই এখন সংকটের মধ্যে আছে।
প্রশাসন বলছে ভুয়া দলিল তৈরি করে চক্রটি ওই জমির দখলে নিয়েছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কাটাবাড়ি পানজুমে এ ঘটনা ঘটেছে।
পান জুমের মালিক জসপার আমলরং দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পান জুমের মালিক আমি। আমার কাগজপত্র আছে। অথচ ভুয়া দলিল দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে পাহারাদার বসিয়েছেন টাট্রিউলি গ্রামের স্থানীয় প্রভাবশালী প্রবাসী রফিক মিয়া। অনবরত পান তুলছেন ও নষ্ট করছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘রফিক মিয়া ও তার সঙ্গীরা আমাদের প্রাণনাশের হুমকিও দিচ্ছেন। একমাত্র আয়ের উৎস পান জুমের টাকা দিয়েই তিন বছর ধরে নিজের ক্যান্সারের চিকিৎসাসহ পরিবার পরিচালনা করছি। কিন্তু, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রফিক মিয়া রাতের আধারে তার দলবল নিয়ে জোরপূর্বক এটি দখল করে। এরপর থেকে জমির চিন্তা ও ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পেরে আমার অবস্থার অবনতি হচ্ছে।’
মঙ্গলবার সরেজমিনে ওই জমি দেখতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয় প্রতিবেদককে। বাধা প্রদানকারীদের পরিচয় জানতে চাইলে তাদের মধ্যে মো. বশির আহমেদ জানান, তিনি এই জুমের কেয়ারটেকার হিসেবে আছেন। এই পান জুমের মালিক রফিক মিয়া। তারা সম্পর্কে ভাই।
এ সময় দুজনকে পান সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।
বশির আহমেদ বার বার দাবি করেন, এই জমির মালিক রফিক মিয়া। এ ব্যাপারে তিনি বশির মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
অভিযুক্ত রফিক মিয়া চিৎকার করে বলেন, ‘আমার জমিতে আপনাকে প্রবেশ করতে কে বলেছে?’
তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে কি আদালতের অনুমতি আছে? আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করবো। আপনি কেন সেখানে গেছেন? আপনি আমার এলাকায় প্রবেশ করেছেন। আপনি কি অনুমতি নিয়েছেন? আমি আপনার নাম ঠিকানা নিয়ে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করবো। আপনি কোর্টে জবাব দিয়েন। আপনি আইন লঙ্ঘন করেছেন। আমরা আপনার ছবি তুলে রেখেছি।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য সিলভেস্টার পাঠাং ও ইসাছড়া পুঞ্জির প্রধান জেনেরাল ধার, পুঞ্জির বাসিন্দা রবিনসন আর্য, নিখিল বিশ্বাস, জামাল মারলিয়া বলেন, ‘রফিক মিয়া ওই পানজুমের বাইরে থেকে ৮-১০ জন লোক এনে ভাড়াটিয়া বসিয়েছে। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পানজুমটি।’
কুবরাজ আন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, ‘পানজুমটি কয়েক বছর যত্ন করার পর পান আসা শুরু হয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই জমিটি রফিক মিয়া ও তার দল দখল করে পান নষ্ট করছেন। এমনকি পান তুলে অবিরত বিক্রিও করছেন। উপজেলা প্রশাসন তাকে পান তুলতে নিষেধ করলেও তিনি প্রশাসনের কোনো কথার তোয়াক্কা করেন না। এতে নিয়ম না মেনে পান তোলায় পান গাছের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এখনই যদি দখলদারদের সরাতে উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে বিপাকে পড়বে পরিবারটি। তাকে এখান থেকে না সরানো হলে একের পর এক প্রথাগত পানজুম দখল হতে থাকবে।’
কুলাউড়া লক্ষ্মীপুর মিশনের ফাদার সুধীর গমেজ বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আছে রফিক মিয়া অসুস্থ জসপারের পানজুম থেকে পান তুলছে। এমন খবরে আমরা গতকাল দুপুরে সরেজমিনে স্পটে যাই। কিন্তু, আমাদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো আমাদের গালিগালাজ করেছেন। তবে, দূর থেকে দেখেছি অর্ধেকের বেশি পান চুরি হয়ে গেছে।’
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আমি দুই পক্ষকে ডেকেছিলাম। কিন্তু, খাসিয়া পরিবারটি উপস্থিত হলেও রফিক মিয়া আসেননি। তখনই আমি রফিক মিয়ার দলিল যাচাইয়ের জন্য ঢাকা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। তাদের দেওয়া তথ্যে এই দলিলের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এই দলিলটি নকল। আমরা খুব শিগগির কার্যকর ব্যবস্থা নেব।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী কমিটির সদস্য ফাদার জোসেফ গমেজ ওএমআই বলেন, ‘পেশীশক্তি ও ভুয়া কাগজপত্রর বলে যদি একটি নিরীহ পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস দখল হয়ে যায়। এটা অত্যন্ত অমানবিক। ফলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পরিবারটি।’
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘আমার জানামতে একটি পক্ষ ভুয়া দলিল দিয়ে মানুষের জায়গা জমি দখল করার চেষ্টা করছে। খাসিয়া পক্ষের মানুষজন আমার কাছে এসেছিল আইনি সহায়তার জন্য। কুলাউড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবার কাগজটি যাচাই বাছাই করার জন্য ঢাকা সাব রেজিস্টার অফিসে পাঠান। সেখান থেকে গত তিন চারদিন আগে আমাদের কাছে তথ্য আসছে দলিলটি ঠিক নেই, দলিলটি ভুয়া। এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কুলাউড়া থানার ওসিকে নির্দেশনা দিয়েছি আইনি ব্যবস্থা নিতে।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘খাসিয়াসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ভূমির অধিকার ও মানবাধিকার সবকিছু দেখার দায়িত্ব হলো সরকারের। তারা ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। হঠাৎ করে প্রভাব দেখিয়ে একটি চক্র তা দখল করে ফেলল। খাসিয়ারা রক্ষার চেষ্টা করলো, ডিসি-ইউএনও অফিসে মিটিং হলো। প্রশাসনও আশ্বাস দিল। আমি খবর পেয়েছি এটা প্রমাণিত হয়েছে, রফিক মিয়া যে কাগজ দেখায় সেটা ভুয়া। জমি কুলাউড়ায় অথচ তিনি ঢাকা থেকে কীভাবে কাগজ সংগ্রহ করেন। এটা অবশ্যই অবৈধ ও ভুয়া।’
‘তারপরেও প্রশাসন এখনো নানান নিয়ম কানুন আইন আদালত দেখিয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখজনক। আমার দাবি, অবিলম্বে প্রশাসনের উদ্যোগে এই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে ঐতিহ্যগত ভূমি খাসিয়াদের কাছে হস্তান্তর করা হোক,’ বলেন তিনি।
Comments