প্রবাসে

ইউরোপের এক বাঙালি সংস্কৃতিকর্মীকে স্মরণ

ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি কমিউনিটির সংস্কৃতি অঙ্গনের এক দ্যুতিময় নক্ষত্রের নাম মুহিত আহমেদ জ্যোতি। তিন বছর আগের অক্টোবর মাসে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। এতোগুলো দিন প্রিয়জন বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে অদৃশ্যে বাস হলেও এখনো স্মৃতিতে জীবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ঘুরে ফিরে নিত্যদিন।
কবিতার মঞ্চে মুহিত আহমেদ জ্যোতি। ছবি: মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ

ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি কমিউনিটির সংস্কৃতি অঙ্গনের এক দ্যুতিময় নক্ষত্রের নাম মুহিত আহমেদ জ্যোতি। তিন বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। এতোগুলো দিন প্রিয়জন বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে অদৃশ্যে বাস হলেও এখনো স্মৃতিতে জীবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ঘুরেফিরে নিত্যদিন।

প্রতিবছর তার চলে যাওয়ার সেই বেদনাঘন দুঃখ ভরা দিনটির স্মৃতি দগদগে হয়ে ভেসে ওঠে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার কয়েকটি পঙক্তিমালার মতোই এক অভিমান জেগে বসে হৃদয়ের কোণে।

“তোমার কিসের তাড়া ছিল অত ?

কেন তুমি সাত তাড়াতাড়ি এই গুলজার আড্ডা থেকে

গুডবাই বলে চলে গেলে, কেন ?

আমরা কজন আজো, তুমিহীন, বসি এখানেই-

তক্কে-গপ্পে, গানে-পানে, জমে ওঠে কিছু সন্ধ্যেবেলা।”          

৯ অক্টোবর ২০১৭, কাজ শেষ করে কর্মস্থল ত্যাগ করেই হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার সময় পথে সংগীতশিল্পী আরিফ রানা ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে একটু থমকে গেলাম।

তিনি লিখেছেন— ‘আজকে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পেরেছি বন্ধু মুহিতের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। ডাক্তারেরা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। একজন সেবিকা জানালেন তোমাদের যা কিছু করণীয় শুরু করতে পার...কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না...একটি অলৌকিক কিছুর অপেক্ষায় আছি... কেন এখনই চলে যাওয়ার তাড়া, অনেক কাজ আছে বাকি, শেষ করতে হবে অসমাপ্ত সব ছবি, ঝগড়া, অভিমান এখনো যে বাকি...।’

স্ট্যাটাসটা পড়ে বুকের মধ্যে একটা কাঁপন অনুভব করলাম। মেট্রো থেকে নেমেই এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করে হাসপাতালের দিকে দ্রুত ছুটে গেলাম। হাসপাতালের নিচতলায় সংস্কৃতিকর্মী অলকা দিদিসহ প্যারিসের আরও কয়েকজন মুহিত ভাইকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয় তলায় কেবিনের সামনে বসা কয়েকজন সমমনা বন্ধুর বিমর্ষ মুখচ্ছবি বলে দিচ্ছে সত্যি কোনো খারাপ সময়ের অপেক্ষায় আছি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মুহিত ভাইয়ের কেবিনের দিকে আমরা কয়েকজন এগোতে লাগলাম। কেবিনের বিছানায় নিথর পড়ে আছে দেহ, দুই চোখে প্রশান্তির ঘুম। মুখের সঙ্গে লাগানো যন্ত্রের সাহায্যে চলছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

আমি কেবিনে দাঁড়িয়ে বুকের স্পন্দন দেখছি আর আশায় বুক বাঁধছি—মুহিত ভাই জেগে উঠবেন, সৃষ্টিকর্তা দয়া করে আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবেন তাকে। কিছুক্ষণ পর করিডরে অবস্থান নিলাম। ২০ মিনিট পর ঘড়িতে রাত ৮টা ৪৫ মিনিট।

অলকাদি কান্নাভেজা চোখে করিডরে এসে জানালেন, শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র খুলে ফেলা হয়েছে। বুঝতে দেরি হলো না, আশাভঙ্গ হয়েছে, মুহিত ভাই দেহত্যাগ করে ওপারে রওনা হয়েছেন। অর্থাৎ কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল যে মানুষটি আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়াতেন, তিনি এভাবে অতীত হয়ে যাবেন ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। আবার ভেতরে ঢুকলাম, এবার যন্ত্রপাতি ছাড়া বিছানায় শুধুই মুহিত ভাইয়ের নিথর দেহ। তার সাত-আট বছরের কন্যাসন্তানটি কিছুক্ষণ আগে আশপাশে স্বাভাবিকভাবে ঘুরঘুর করছিল বাবার সুস্থতার অপেক্ষায়। তাকে এবার দেখলাম অপেক্ষমাণ কক্ষে বাবা হারানোর বেদনায় কান্নাভেজা চোখে। এমন দৃশ্য দেখা ছিল সত্যি কঠিন।

মুহিত ভাই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু আচরণে ছিলেন প্রতিভার অহংকারমুক্ত একজন সংস্কৃতি শ্রমিক। দূর পরবাসে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের জন্য যে মানুষগুলো নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ, মুহিত ভাই ছিলেন ইউরোপের বাংলা কমিউনিটির সংস্কৃতি অঙ্গনে তেমনি এক শিল্প ভাবনার এক সাধক মানুষ। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা বা আড্ডার সুযোগ আমার খুব কম হয়েছে। যতটুকু কথা, যোগাযোগ ও আন্তরিকতার সৃষ্টি হয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে। তিনি মিডিয়ার ঘোষিত কোনো তারকা শিল্পী ছিলেন না, কিন্তু তার শিল্পকর্মের মধ্যে তারার জ্যোতি ছিল। শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে যে ধরনের আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণের মানুষ হওয়া যায়, সেই গুণাবলি তার চলনবলন, কথা ও মানুষের সঙ্গে মেশার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেত। প্যারিসের কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান তার রং-তুলির আঁচড় কিংবা তার উপস্থাপনা ছাড়া যেন একটু অসম্পূর্ণ থেকে যেত। নিজে নানা গুণের অধিকারী হলেও, সামান্য গুণের মানুষকেও অন্যের কাছে বড় করে উপস্থাপন করতেন। বন্ধু মনে করে কখনো ঠাট্টার ছলে কাউকে কিছু বললে, তা কেউ গ্রহণ করতে না পারলে তা আবার ঠাট্টার মধ্য দিয়ে মুহূর্তেই পরিবেশ আনন্দঘন করার এক সম্মোহনী গুণের অধিকারী ছিলেন।

প্যারিসে ‘অক্ষর’ নামে কবিতাভিত্তিক একটি সংগঠনের সঙ্গে আমি জড়িত। ডিজিটাল যুগে সব অনুষ্ঠানে ডিজিটাল প্রিন্টিং ব্যানার ব্যবহার হলেও আমাদের কবিতার অনুষ্ঠানগুলোর ব্যানার হতো মুহিত ভাইয়ের শৈল্পিক হাতের রং তুলির তৈরি ব্যানার দিয়ে। শুধু ব্যানারের কারণেই অনুষ্ঠানের ষাট ভাগ সৌন্দর্য বেড়ে যেত। অনুষ্ঠানের দিন কখনো ব্যানারটি আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন না। নিজের থেকেই মঞ্চসজ্জা থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত সার্বিক সহযোগিতায় পাশে থাকতেন। এত কিছু করার পর আবার মঞ্চে গিয়ে কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করতে কোনো বিচ্যুতি ধরা পড়ত না।

একজন শিল্পীর শৈল্পিক সেবার পাশাপাশি যে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে, সেই কর্তব্যের জায়গায় তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সংকটে প্রবাসের যে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হয়, সেই সব জাতীয় ও আপামর মানুষের স্বার্থের কর্মসূচিগুলোতে মুহিত ভাইয়ের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত।

প্যারিসের বৃহৎ বাংলা কমিউনিটির মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির তারকা ব্যক্তিত্ব অনেকেই রয়েছেন। কিন্তু মুহিত ভাইয়ের মতো সেবক বা শ্রমিকমনা সংস্কৃতিকর্মী আজও সৃষ্টি হয়নি। তার  প্রস্থানে  কমিউনিটির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা আজও পূরণ হয়নি।

লেখক:মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ, সংস্কৃতিকর্মী প্যারিস, ফ্রান্স।

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

6m ago