শিক্ষার্থীদের থেকে সবচেয়ে ভালোটা যেভাবে পেতে পারি
আমাদের শিক্ষার্থীদের কীভাবে দেখা উচিৎ- গ্রাহক নাকি পণ্য হিসেবে? আমার ৪০ বছরেরও বেশি সময়ের অ্যাকাডেমিক জীবনে তাদের দেখি একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিতে। আমার নজরে তারা জ্ঞানের সহ-স্রষ্টা। যখন তাদের চিন্তা, সংযোগ, সংশোধন এবং তৈরি করার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয় তখন তারা তাদের সর্বোত্তমটাই দেয়। আরও একটু এগিয়ে দিলে তারা জ্ঞান উত্পাদকও হতে পারে। তাদের জন্য আমার শ্রদ্ধা কেবল বেড়েছে। তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে পেরে নিজে উল্লেখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই জ্ঞান সন্ধানী। তাদের জানার আগ্রহ, চর্চা এবং গবেষণা রিপোর্ট অত্যন্ত সৃজনশীল। তাদের সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক সুযোগ দেওয়া গেলে সহজেই দারুণ কিছু আইডিয়া নিয়ে আসে।
কিছু শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেরাটি বের করে আনতে পারেন। তবে সব শিক্ষক তা পারেন না। নিত্যনৈমিত্তিক ক্লাস করতে করতে শিক্ষার্থীরা প্রায়শই হতাশ, অমনোযোগী, উদাসীন হয়ে পড়ে এবং নিঃসঙ্গ অনুভব করে। এর অর্থ স্পষ্টতই তারা কিছুই শিখছে না। ফলস্বরূপ, তারা অমনোযোগী হয়ে যায় এবং উদ্যম ও সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে।
সাধারণ শিক্ষকদের পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং মূল্যায়নের কৌশলগুলোও খুব দুর্বল। তারা মুখস্থকরার ওপর জোর দেন। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা তাদের সুপ্ত প্রতিভা দেখানোর সুযোগ আর পায় না।
আমি দেখেছি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ‘মঙ্গল তরি’ বানিয়েছে এবং সমাজের দরিদ্র মানুষদের জন্য কম খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির মতো কার্যকর ধারণা উপস্থাপন করেছে। সৃজনশীলতা তাদের জিনে রয়েছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে স্নাতক শিক্ষার্থীদের রিসার্চ মেথড কোর্স পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। কোর্স থেকে তিন শিক্ষার্থীর একটি দল ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সম্মেলনে একটি গবেষণা পত্র উপস্থাপন করতে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। সেমিস্টার শেষ হওয়ার পরেও সেই তিন জন আমার সঙ্গে কাজ করতে থাকে।
আইবিএতে শিক্ষকতা করার সময়, শিক্ষার্থীদের কারখানায় ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কথা বলে এবং পাঠ্য-পুস্তকের তত্ত্বগুলোর সঙ্গে তা মিলিয়ে নিজস্ব দর্শন নিয়ে হাজির করেছিলাম। সরেজমিনে সব দেখে তারা যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে তা দেখা কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল। আমার অনেক শিক্ষার্থী এখন সিইও, একাডেমিক নেতা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে গেছে। দূর থেকে আমি গর্বের সঙ্গে তাদের দেখেছি। তারা তাদের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করছে। এমনই একজন সিইও তার ক্লাসরুমের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন, যা দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়।
পেন স্টেটেও আমি প্রায় তিন দশক ধরে পড়িয়েছি। সেখানেও আমার শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বার্ষিক পেন স্টেট বহেরেন্ড-সিগমা সিগার আন্ডারগ্রাজুয়েট গবেষণা এবং ক্রিয়েটিভ কমপ্লিমিশন কনফারেন্সে পুরষ্কার অর্জন করেছে। আমি বিশ্বাস করি তারা সেটা পেরেছে ক্রমাগত অজানাকে জানার চেষ্টা আর উত্তর খুঁজতে গিয়ে। একজন তরুণ শিক্ষার্থী সম্প্রতি আমাকে ইমেইল করেছে, ‘আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনি না থাকলে সাক্ষাতকারে আমি যে সব বিস্তৃত গবেষণা উপস্থাপন করেছি, যেগুলো করতে আমি সক্ষম তা আনতে পারতাম না।’
গুগল ফর্মের মাধ্যমে একটি জরিপ করা হয়েছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে। তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত আশ্চর্যের। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে কত শিক্ষার্থী নিজেদের অবহেলিত মনে করে, তাদের একাডেমিক প্রোগ্রামগুলোকে দুর্বল মনে করে, ওয়েল রাউন্ডেড শিক্ষার মারাত্মক অনুপস্থিতি অনুভব করে, একাডেমিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না, স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে না এবং ক্লাসের বাইরে অনেক শিক্ষক সাধারণ কথোপকথনের জন্যও সময় দিতে চান না ও খারাপ ব্যবহার করেন।
অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্টটি (টি-এইপি) এখন ৫০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ২০০ জনের বেশি উত্তরদাতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং জরিপের ফরমটি শেয়ার করা অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন উত্তর প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে। তাদের প্রতিক্রিয়াগুলো সৎ, প্রত্যক্ষ এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। জরিপ থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত তিন জন শিক্ষার্থীর মতামত এখানে দেওয়া হলো-
‘ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি অনুভব করি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পাঠদানে ফোকাস করা উচিত নয়। তাদের বাস্তব জ্ঞানে মনোনিবেশ করা উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে আমাদের একটি কমপ্যাক্ট গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা প্রয়োজন। এভাবেই তারা আমাদেরকে জব মার্কেটে প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।’
‘প্রতিষ্ঠানগুলো কি তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার দৃঢ় ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করে? তারা কি জনগণের কষ্ট অনুভব করানোর চেষ্টা করে?’
‘শিক্ষাঙ্গন এবং শিল্পের মধ্যে সহযোগিতা অনেক উন্নত করা উচিত। বেশিরভাগ ব্যবসা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সহযোগিতা না করে শুধুই অর্থোপার্জনে মনোনিবেশ করছে।’
মজার বিষয় হচ্ছে, টি-এইপি প্রকল্পটি অধ্যয়নের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের গভীর সংযোগ স্থাপন করেছে। যার ফলে, তাদের কাছে অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে নির্দ্বিধায় মন খুলে সব বলে দিচ্ছেন। তাদের সেই এই গল্পগুলোই আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো একটি অপ-এড সিরিজে রূপান্তরিত করা হয় হয়েছে। গল্পগুলো কখনও কখনও তীব্র এবং তিক্ত। তবে ক্ষমতার শিখরে যারা রয়েছেন তাদের কাছে আবেদন জানাতে যথেষ্ট শক্তিশালী। এই কণ্ঠগুলো তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি দ্য ডেইলি স্টারের কাছে কৃতজ্ঞ। প্রতি শুক্রবার অপ-এড পাতায় প্রিন্টের পাশাপাশি প্রতি রোববার অনলাইন বাংলায় এটি প্রকাশ করা হবে।
শিক্ষাবিদ এবং প্রশাসকদের এই কণ্ঠগুলো অবশ্যই শোনা উচিৎ। এতে তারা জানতে পারবেন কোন বিষয়টি আর কাজ করছে না। তারা জানতে পারবেন, শিক্ষার্থীদের এটা মনে করা দরকার যে তারা একটি যত্নবান প্রতিষ্ঠানের অংশ, যে প্রতিষ্ঠান তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতের ৪আইআর এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম করে তুলবে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই তিনটি শর্ত পূরণ করতে পারে তবে এই দেশ যে মানবসম্পদ উৎপন্ন করবে তা তাদের পরিবার, প্রতিষ্ঠান, নিয়োগকারী এবং দেশকে আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ফিরিয়ে দেব।
সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়ার জন্য আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে, উচ্চতর ক্যালিবারের জন্য একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা দিতে হবে এবং আমাদের উচ্চতর শিক্ষার সঙ্গে এগুলো ভালোভাবে সংহত করতে হবে।
আমার সহকর্মী শিক্ষাবিদদের কাছে আমার একটি সহজ আবেদন: এই তরুণদের কথা শোনার সংস্কৃতি তৈরি করুন। আমি বিশ্বাস করি, তারা সম্মানজনক উপায়ে পরামর্শ দেবে যে আমরা কীভাবে তাদের সঙ্গে আরও ভালভাবে যুক্ত হতে পারি। এরপর আপনার ধারণার সঙ্গে তাদেরটা মিলিয়ে একটি অবিস্মরণীয় শিক্ষার অভিজ্ঞতা দিতে পারবেন। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সূচকগুলোর পরামর্শ অনুসারে বাংলাদেশ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে পরবর্তী প্রজন্মকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দেশ আরও উন্নতি করতে পারে। তারা জাতির ভবিষ্যৎ; তাদের জন্য আরও ভালো শিক্ষার অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে!
ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন ড. আন্দালিব। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments