অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট

পড়াশোনায় আনন্দ ফেরাতে হবে

‘চলার সময় শ্বাস নেওয়ার মতোই পড়াশোনায় আনন্দ অপরিহার্য।’- সাইমন ওয়েল সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে বেশ ভালো সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে বের হন। তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকার অর্থে শেখার বা জ্ঞানার্জনের আনন্দটা পান? এই প্রশ্নের উত্তর দেশের প্রতিটি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই দেওয়া উচিত।

‘চলার সময় শ্বাস নেওয়ার মতোই পড়াশোনায় আনন্দ অপরিহার্য।’- সাইমন ওয়েল

সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশে বেশ ভালো সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে বের হন। তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকার অর্থে শেখার বা জ্ঞানার্জনের আনন্দটা পান? এই প্রশ্নের উত্তর দেশের প্রতিটি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই দেওয়া উচিত।

কিছু বিষয় নতুন কিছু শেখার আনন্দ বয়ে আনতে পারে- একটি নতুন অভিজ্ঞতা মানুষকে আরও কৌতূহলী করে তোলে এবং চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ দেয়। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে বেড়ে ওঠার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশ বদলের হাতিয়ার হিসেবে প্রস্তুত করতে অবশ্যই সঠিক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা দিতে হবে। তারা যদি আনন্দের সঙ্গে না শেখে তাহলে কী আসলেই তারা কিছু শিখছে?

মনোবিজ্ঞানীরা শেখার আনন্দকে বিজয়ের অভিজ্ঞতা হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। ‘সংগ্রাম নেই, অগ্রগতি নেই।’ ফ্রেডরিক ডগলাস দাবি করেন যে পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে চ্যালেঞ্জ: শিক্ষার্থীরা তখনই জ্ঞানার্জনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে যখন তারা মধ্যবর্তী ছোট লক্ষ্য অর্জনের স্বাদ গ্রহণ করবে। নির্ধারিত কাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিক দক্ষতার ভারসাম্যও অত্যাবশ্যকীয়। তাদের সামনের চ্যালেঞ্জ এমন হওয়া উচিত না যাতে করে শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত চাপে হতাশায় ভুগতে থাকে। বরং তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ এমন হওয়া উচিত যাতে করে তারা তাদের স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা এবং সহজাত সম্ভাবনা খুঁজে পায়। শিক্ষকরা যদি তাদের কোর্সগুলোকে মজাদার করার জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং প্রচেষ্টা না চালান তাহলে শেখার প্রক্রিয়াটি কখনই উপভোগযোগ্য হয়ে উঠবে না। শিক্ষকরা যদি শেখাতে পছন্দ করেন তাহলে শিক্ষার্থীদেরও শেখার আনন্দ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের নামি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কিছুটা চেষ্টা করার প্রয়োজন পড়ে এবং ধারণা করা হয় যে শিক্ষার্থীরা একটি সমৃদ্ধ শিক্ষার অভিজ্ঞতা পাবে। ভর্তির পর প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আবেগ ভরা অনেক কথা বলে থাকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের কাছেই সেই আবেগ নষ্ট হতে শুরু করে। কারও কারও কাছে এই আবেগ অনেক দ্রুত নষ্ট হয়। বলতে গেলে প্রায় চোখের পলকেই। নতুন কিছু সৃষ্টির বদলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিতাব মুখস্থ করতে এবং একের পর এক পরীক্ষা দিতে। ফলে প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় শিক্ষার সঙ্গে মানসিকভাবে জড়িত হতে না পেরে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল ধারণাগুলো বইয়ের পাতার ভাজে ভাজে চাপা চাপা পরে যায়। তাদের একঘেয়েমি এবং হতাশাগ্রস্ত অবস্থা অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতাকে আর আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে না।

শিক্ষার্থীদের অনেকের কাছেই মনে হয় তারা সত্যিকারের শিক্ষা পাচ্ছে না এবং তারা ভাবতে থাকে- কেন আমি এখানে আছি? আমাদের দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেছিল, ‘প্রতিষ্ঠানের গৌরব নিয়ে দম্ভ করা উচিত না। পদ্ধতিগত পরিবর্তন, শিক্ষার্থীদের শেখার সক্ষমতা বাড়ানো এবং পাঠ্যক্রম যথাযথভাবে আপডেট করা উচিত। এই পৃথিবীর দক্ষতা প্রয়োজন, সার্টিফিকেট নয়।’ দুর্ভাগ্যক্রমে, আজকাল বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বিশ্বাস যে তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেবল একটি সার্টিফিকেট অর্জন করবে।

এই অবস্থা শুধু দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের না। কারও কারও মতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এর চেয়েও খারাপ। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা সম্ভবত আরও খারাপ!

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক প্রোগ্রাম এবং পাঠ্যক্রমগুলো অকল্পনীয়, পুরানো এবং বেশ বিরক্তিকর। কোর্সগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরির সুযোগ নেই। ব্লুমস টেক্সোনমির আলোচনায় উচ্চশিক্ষার কোর্সগুলো এখনও ‘মুখস্থ’ বিদ্যার ওপর ফোকাস করে। যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু মৌলিক ধারণা এবং ঘটনাগুলো মুখস্থ করে এবং সেগুলোই আবৃত্তি করে। কেউ কেউ এটাকে তোতা পাখির বুলি বলে থাকেন। টেক্সোনমির উচ্চ স্তরে পৌঁছনো এমন একটি বিষয় যা তারা শুধু স্বপ্নেই দেখতে পারে। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রকমের তথ্যের মাঝে ঘিরে থাকে। সেখানে তাদের একাডেমিক প্রোগ্রাম এবং পাঠ্যক্রম পুরনো আমলের। শিক্ষার্থীদের ‘মনোযোগী’ করানো হয় পরীক্ষার বিষয়ে। ফলে তারা নিয়মিত ক্লাস করে এবং কয়েক বছর আগে সিনিয়রদের তৈরি নোট মুখস্থ করে।

সব বিষয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দায়ী করা যায় না। তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ভুগছেন, যা নির্ধারণ করতে পারেনি যে পরিবর্তন কীভাবে করতে হবে। আয় এবং ব্যয় সবসময়ই একটি বড় সমস্যা। লক্ষ্য পূরণের জন্য ফ্যাকাল্টি সদস্যদের ওপর অযৌক্তিক পরিমাণ কোর্সের লোড দেওয়া হয়। আপনি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করতে চান যে শেখার প্রক্রিয়াটিকে আকর্ষণীয় এবং অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে তারা কেন আগ্রহী হন না? তাহলে যে উত্তরটি অদৃশ্যভাবে প্রকাশিত হবে সেটা হলো- একগাদা কোর্স এবং একঘেয়ামি ক্লাসের চাপে তারা পিষ্ট। এর পাশাপাশি তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং গবেষণা পরিচালনা করবেন বলেও প্রত্যাশা করা হয়! প্রায়শই তারা সূক্ষ্ম হুমকির মাঝে এমন চাপে পড়ে যান যে কোনও পরিবর্তন আনার চেষ্টা আর করেন না।

শিক্ষায় আনন্দ ফেরাতে অনেক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং প্রেরণাদায়ক শিক্ষকরা সাধারণত শিক্ষার্থীদের অর্জনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেন। তবে এর জন্য প্রশিক্ষণের কিছু উপাদানেরও প্রয়োজন হয়। নতুন এবং অভিজ্ঞ সকল শিক্ষকেরই ক্লাসরুমের ভিতরে এবং বাইরে অংশগ্রহণমূলক এবং চ্যালেঞ্জিং শেখার পরিবেশ তৈরি করতে পারে এমন উপায় নিয়ে কাজ করা উচিত। শেষ পর্যন্ত যারা নতুন ধারার শিক্ষা গ্রহণ করে এবং অভিযোজিত হয় সার্টিফিকেটধারী হবে তারাই দেশের শিক্ষার পরিবেশ পরিবর্তনের অগ্রদূত হতে পারবে।

অবশ্যই, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যুক্তিসঙ্গত ক্লাসের সংখ্যা এবং উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল শিক্ষকদের জন্য পুরষ্কার থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের যদি মানব সম্পদ, ভবিষ্যতের নেতা, সমস্যা সমাধানকারী এবং সচেতন ও বিবেকবান নাগরিক হিসেবে রূপান্তর করতে হয়, তবে এই ধরনের পরিবর্তন আবশ্যক। উচ্চশিক্ষার প্রসারে পরিবর্তন আনতে নতুন চিন্তা আবশ্যিক। পরিবর্তিত চিন্তার সঙ্গে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা ভবিষ্যতের প্রজন্মকে লালন করতে যোগ্য এবং সৃজনশীল ভূমিকা গ্রহণ করবে। সব স্তরে নতুন শিক্ষকরা এদেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে একটি বিপ্লব আনতে পারেন। প্রশ্ন হলো এই পথটি কে তৈরি করবেন? কখন করবেন?

 

মিমোসা কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন ড. আন্দালিব। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থীদের থেকে সবচেয়ে ভালোটা যেভাবে পেতে পারি

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago