জীবনে প্রথমবারের মতো পরাজয়ের মুখোমুখি ট্রাম্প

Donald Trump.jpg
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

‘আমি সবসময়ই জিতেছি। শেষ পর্যন্ত আমি সবসময়ই জয়ী হই...’ নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাচনে জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি হেরে গেছেন।

পলিটিকো ম্যাগাজিনে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাইকেল ক্রুজ বলেন, ‘জীবনে কখনো “পরাজিত” হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার জন্য নিরলসভাবে লড়াই করেছেন ট্রাম্প। পরাজয়কে তিনি জীবনের জন্য দুষিত বলে মনে করেছেন। তিনি কখনোই পরাজয় মেনে নিতে শেখেননি।’

নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিকেই ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘সরল সত্যটি হলো নির্বাচন এখনও দূরে।’ আগে থেকেই নির্বাচনকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি কোনও প্রমাণ ছাড়াই তার বিরুদ্ধে বিপুল জালিয়াতি হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন।

তবে, বাস্তবতা হলো তিনি হেরে গেছেন। যদিও ট্রাম্প ফ্লোরিডা ও ওহাইওতে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন এবং ২০১৬ সালের তুলনায় আরও বেশি ভোট পেয়েছেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজিত হয়েছেন কারণ তিনি হেরে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে যথেষ্ট মানুষের সমর্থন পাননি। তিনি পেনসেলভেনিয়াতে হেরেছেন। উসকনসিন ও মিশিগানেও হেরেছেন। 

মাইকেল ক্রুজের মতে, গত অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ট্রাম্প নিজের ব্যর্থতাকে বিশ্বের সামনে নানা অযুহাতে ঢেকে রাখতে সফল হয়েছেন। কর্মজীবনের শুরুতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির জন্য অন্যদের উপর ঝুঁকির ভার চাপিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দেউলিয়া হওয়া থেকে বেঁচে যান তিনি। বরাবরই পরাজয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যাতে করে ব্যর্থতার দায় এড়ানো যায়। ঋণদানকারী সংস্থা থেকে শুরু করে প্রসিকিউটর, রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিসহ তিনি সবসময় এমন মানুষদের পাশে রেখেছেন যাদের মাধ্যমে তিনি নিজে উপকৃত হতে পারেন।

এই বছর নির্বাচনে কয়েক লাখ ভোটার জো বাইডেনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন। তারা ট্রাম্পকে এমন একটি সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, যেটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে দ্বিধায় ছিলেন।

২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্পের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল তা চার বছরে হারিয়ে গেল কেন?

মাইকেল ক্রুজ বলেন, ‘নির্বাচনী হিসাব নিকাশের বাইরেও ৪৫তম প্রেসিডেন্ট তার চারিত্রিক মূল বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হননি।’

সাধারণত, একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রেসিডেন্ট জনগণের ব্যাপক সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন- তবে ট্রাম্প এক্ষেত্রে ভিন্ন।

মাইকেল ক্রুজ বলেন, ‘তার (ট্রাম্পের) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই চার বছরে হোয়াইট হাউজও কিছুটা অনিশ্চয়তায় পড়ে। কারণ তিনি প্রশাসনের সদস্যদের চাপ দিতে আগ্রহী ছিলেন। এছাড়াও তিনি এমন কিছু কর্মী তৈরি করেছেন যারা সবসময় তার গুণগান গাইতেন, তার নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যেও সন্তোষ দেখাতেন,  তারা “ট্রাম্পকে ট্রাম্প হতে দিয়েছেন”।’

বিভাজন ও বিশৃঙ্খলাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার কারণে রাজনীতিবিদদের মধ্যেও দূরত্ব বেড়েছে বলে মনে করেন ক্রুজ। ঝগড়া-বিবাদ ও টুইটে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত ছিল। এসব নিয়ে আমেরিকানদের একটি বড় অংশ বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এমনকি এর মধ্যে ট্রাম্পের ওয়াশিংটন সহযোগীদেরও একটি বড় অংশ আছেন।

মাইকেল ক্রুজ আরও বলেন, ‘ট্রাম্প এক ধরনের ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বাস্তবতার চেয়ে তিনি নিজের ভাবমূর্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কখনো নিজের দোষ স্বীকার করতে চাননি। কখনো কোনো প্রশংসায় অন্যকে ভাগও বসাতে দেননি।’

ট্রাম্পের এ পরাজয়ের পেছনে চলমান করোনাভাইরাস মহামারিকে একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন মার্কিন লেখক টিম ও’ব্রায়েন।

তিনি বলেন, ‘মহামারির কারণে শেষ বছর ট্রাম্পের যে কৌশল, নানা অযুহাতে  নিজের ব্যর্থতা ঢেকে রাখা- সেটা অকেজো হয়ে যায়। ফলে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, ট্রাম্পের মূল সমস্যাটি ছিল ‘তার রিকটার স্কেলের আত্মকেন্দ্রিকতা।’

টিম ও’ব্রায়েন আরও বলেন, ‘এই পৃথিবীতে আপনি যদি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে না ভাবেন, তবে আপনি স্বাভাবিকভাবেই অন্য মানুষের জন্য কখনোই কিছু করতে পারবেন না।’

ট্রাম্পের আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপর আচরণ নিয়ে রিপাবলিকান স্পিকারদের সাবেক শীর্ষ সহযোগী ব্রেন্ডন বাক বলেন, ‘সবকিছু তার (ট্রাম্পের) নিজের অহংকারের চারপাশে ঘোরে। তার এই স্বার্থপরতা কিন্তু কোনো লক্ষ্য বা এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে বা কোনও বিশেষ উপায়ে বিশ্বকে পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। তিনি কেবল নিজের জন্য এবং শেষ দিকে কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কাজ করেছেন।’

যেসব কারণে আগেরবার তিনি জয় পেয়েছিলেন সেসব কারণেই চার বছর পর তিনি হেরেছেন বলে জানিয়েছেন ডেমোক্রেটিক কৌশলবিদ বব শ্রাম। তিনি জানান, ট্রাম্প চার বছরে নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করেননি বরং আরও উদ্ধত্য হয়েছেন। তাই আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের কাছে তিনি একজন ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট।

তিনি আরও বলেন, ‘আপনি আপনার প্রবৃত্তি ও স্বার্থপরতাকে নিয়ন্ত্রণ না করে কখনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে সফল হতে পারবেন না। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।’

রিপাবলিকান পরামর্শদাতা রব স্টুটজম্যান বলেন, ‘তার স্বার্থপর আচরণই তার গ্রহণযোগ্যতা কমিয়েছে। যদিও তিনি মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। তবে তিনি গত চার বছরে তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, অন্যদের উদ্ভট সব নাম ধরে মন্তব্য করা, অহংকার, গণমাধ্যমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের কারণে তিনি হাস্যকর এক ক্যারিকেচারে পরিণত হয়েছেন।’

মাইকেল ক্রুজের মতে, রাজনৈতিকভাবে, আইনীভাবে, আর্থিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের নিজের জন্যও এই পরাজয়ের পরিণতি বড় আকার ধারণ করতে পারে।

তবুও, পরাজিত হওয়ার পরেও ট্রাম্প আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ‘প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্রের মেরুকরণকে তীব্রতর করা, মানুষের মধ্যে বিভাজন ও বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রভাব ফেলেছেন ট্রাম্প। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করেছেন, বিজ্ঞান নিয়ে অযৌক্তিক সব মন্তব্য করেছেন। বিশ্বের বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ স্বৈরশাসককে নিজের মিত্র বানিয়েছেন।

মাইকেল ক্রুজ বলেন, ‘এ বছরের নির্বাচনী ফলাফল, জীবন থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হারানো ট্রাম্পকে এমন এক মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যা তিনি কখনও সহ্য করতে পারেননি আর সেটি হলো একজন “পরাজিত ব্যক্তি”।'

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago