বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন ড. এ এ মামুনের বিশেষ সাক্ষাৎকার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন বিশ্বের শীর্ষ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষকদের প্রকাশিত একটি জার্নালে এ তালিকাভুক্তি হয়েছে। যেখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রায় এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৮৩ জন বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে ড. এ এ মামুনের ৪১৭টি প্রকাশনা রয়েছে এবং তার গবেষণা থেকে ১৪ হাজারেরও বেশি উদ্ধৃত করা হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানে অবদানের জন্য এ অধ্যাপক ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন।
তিনি ২০০৯ সালে পদার্থবিদ্যায় অসামান্য অবদানের জন্য জার্মানির আলেকজান্ডার ভন হোমবোল্ট ফাউন্ডেশন থেকে ফ্রেড্রিক উইলিয়াম ‘ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন।
ড. মামুন যুক্তরাজ্যের সেন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি অর্জন করেছেন এবং তিনি জার্মানির হোমবোল্ট পোস্টডক ফেলো।
অধ্যাপক ড. এ এ মামুন তার দীর্ঘ গবেষণা জীবন নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের জাবি সংবাদদাতা মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে।
ডেইলি স্টার: কেমন আছেন স্যার?
ড. মামুন: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
ডেইলি স্টার: আপনার বেড়ে ওঠা কেমন ছিল?
ড. মামুন: মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের এক মধ্যবিত্ত শিক্ষক পরিবারে বেড়ে ওঠা আমার। জাহাঙ্গীরনগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে সুযোগ পেয়েও পড়িনি। আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে। তিনি আমাকে ছাত্র থাকা অবস্থাতেই ড. মামুন বলে ডাকতে পছন্দ করতেন।
ডেইলি স্টার: গবেষণায় হাতেখড়ি হয় কীভাবে?
ড. মামুন: আমার গবেষণায় হাতেখড়ি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মরহুম অধ্যাপক ড. এম সলিমুল্লাহ স্যারের হাত ধরে। যিনি একজন নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাকে সবসময় অনুসরণ করতাম। স্যারের প্রায় দুই শতাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ ছিল। যা অমর কীর্তি।
ডেইলি স্টার: গবেষক হিসেবে আপনার পরিচিতি নতুন নয়। কিন্তু এবারের ‘শীর্ষ দুই শতাংশ’ বিজ্ঞানীদের মধ্যে নিজের স্বীকৃতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. মামুন: যেকোনো স্বীকৃতি কিংবা অ্যাওয়ার্ড পাওয়া মূলত মানুষকে নতুন উদ্যমে কাজ করতে উৎসাহিত করে। একজন বিজ্ঞানী তার জীবনে রিকগনিশন (স্বীকৃতি) ছাড়া আর কিছুই চায় না। এবারের স্বীকৃতি আসলে দীর্ঘদিনের কাজের ফসল। যা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
ডেইলি স্টার: এই গবেষণায় উদ্দীপনার শুরুটা কেমন ছিল আপনার?
ড. মামুন: আমি যখন বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স থেকে জুনিয়র গোল্ড মেডেল ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র গোল্ড মেডেল পাই, তখন আমি ভীষণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। পরবর্তীতে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, কমনওয়েলথ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি আমাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। ‘হোমবোল্ট পোস্টডক ফেলোশিপ’ আমাকে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে, আরও উন্নতমানের গবেষণার সুযোগ দিয়েছে। এই কাজগুলি আমাকে আরও নতুন নতুন কাজ করতে উৎসাহিত করেছে।
ডেইলি স্টার: জার্মানির ‘ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড’ ডিগ্রি নিয়ে আলাদা করে কিছু বলবেন?
ড. মামুন: হ্যাঁ, জার্মানির এই ডিগ্রিটি অত্যন্ত সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ড। নোবেল প্রাইজের পরেই সম্মানীর দিক থেকে এটি সর্বোচ্চ। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আমি যখনই চাইব সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে তিনমাস করে জার্মানি থাকতে পারব।
ডেইলি স্টার: আপনি জাবির বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি (দ্বিতীয়বারের মতো)। গবেষকরা সচরাচর রাজনীতিতে সক্রিয় হন না। কিন্তু আপনি কেন শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন?
ড. মামুন: শিক্ষক রাজনীতিতে এসেছি ‘গুনগত মান’ পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে। আমি ভেবেছি, আমি তো ব্যক্তি একজন। আমার চার শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি- আমি যদি বিশ জন ভালো শিক্ষক কিংবা ভালো পরিবেশ তৈরি করতে পারি, তাহলে বিশ জনের আউটপুট অনেক বেশি হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণামুখী করে এগিয়ে নিতে চাইলে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন- আইনস্টাইনও একসময় পলিটিক্সে (রাজনীতিতে) সক্রিয় হয়েছিলেন। শুধু যে নিজে গবেষণা করব, গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করব না, সেটি ঠিক না।
ডেইলি স্টার: প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধাবীদের বাদ পড়ার অভিযোগ মেলে। মেধাবীরা নিয়োগবঞ্চিত হলে গবেষণার অগ্রগতি অসম্ভব। এর সঙ্গে শিক্ষক রাজনীতির সম্পর্ক দেখেন?
ড. মামুন: গবেষণাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে প্রয়োজন ‘ভালো শিক্ষক’। যেটি এক নম্বর প্রাধান্য। তাহলে শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়া করতে আগ্রহী হবে, শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখবে, গবেষকও হতে চাইবে। আর যদি মেধাহীনরা নিয়োগ পায়, তাহলে মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কোনো খারাপ মানের শিক্ষক নিয়োগ হলে বিশ্ববিদ্যালয় তিন যুগ ধরে ভোগান্তি বয়ে বেড়াবে। মূলত এটি চাইতে গিয়েই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলাম। আমি ভালো শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে খুবই কনসার্ন। এরকম অভিজ্ঞতা আমার এক ছাত্রের সঙ্গেই ঘটে ছিল। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েও নিয়োগ তো দূরের কথা, তাকে ভাইভা কার্ডও ইস্যু করা হয়নি। এটি ছিল সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের সময়ে। তারপর থেকেই আমি প্রতিবাদে সরব হয়েছিলাম। এরপরেই শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সভাপতি (২০১২) হয়েছিলাম। এখনও অবধি সরব আছি।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীদের অনেক সময়ই ক্লাসের প্রতি অনীহা থাকে। ক্লাসে ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখতে একজন শিক্ষকের কী ফোকাস করা করনীয় বলে মনে করেন?
ড. মামুন: যে থিওরি ১০০ বছর আগে এসেছে, সেটি তো পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়, সেগুলি আমাদের জানতে হবে। সাইন্স তো আজ যেটি বলে, কাল সেটির পরিবর্তন হতে পারে। শিক্ষকদের আপ-টু-ডেট হওয়া উচিত। এমন যে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর কোর্স-কারিকুলামে পরিবর্তন আনা উচিত। ক্লাসে শিক্ষক যেটি পড়াবেন, সেটির বৈশ্বিক সর্বশেষ তথ্য সংযোজন করার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে শিক্ষকদের।
ডেইলি স্টার: বর্তমান শিক্ষকরা কেন গবেষণায় আগ্রহী কম বা কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
ড. মামুন: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণাকে খুব বেশি উৎসাহিত করা হচ্ছে না। কিংবা এর ভিত্তিতে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা কম-বেশিও করা হচ্ছে না। তার চেয়ে উপাচার্যদের সঙ্গে বেশি বেশি দেখা সাক্ষাৎ করা, সময় দেওয়া ইত্যাদিতেই বেশি মনোযোগ। আমাদের জাহাঙ্গীরনগরে তো অনেক কম। আমাদের উপাচার্য তো কাছেই যেতে দেন না। কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও খারাপ অবস্থা। গবেষণা তো কষ্টের কাজ। এটি ছাড়া শিক্ষকরা সহজেই যদি পদোন্নতি পেয়ে যান, তাহলে এতো কষ্ট করতে যাবেন কেন? এভাবে চললে শিক্ষকদের আগ্রহী হয়ে উঠা বেশ কঠিন।
ডেইলি স্টার: শিক্ষা ও গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ হয়, সেটি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন কি?
ড. মামুন: আসলে অপর্যাপ্ত বলব না। কারণ, অর্থের অভাবে গবেষণার কাজ থেমে যেতে খুব কমই দেখেছি। তবে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। যে অর্থ ররাদ্দ হয়, সেটির যথাযথ ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতেও গবেষণার সুযোগ একদমই অপ্রতুল নয়।
ডেইলি স্টার: গবেষণা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
ড. মামুন: আমার গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল করছি। আমার সব সম্মাননা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ‘ড. এ এ মামুন ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট করে যাওয়ার ইচ্ছা আছে, যেটি গবেষণা করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেবে। এই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখি। আমি ইউরোপ, আমেরিকা, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু যাইনি। আমি এ দেশেই মরতে চাই।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. মামুন: একজন শিক্ষক যেমন তার ছাত্রের কাছে হেরে গিয়ে আনন্দ পায়, ঠিক তেমনি আমিও আনন্দ পাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমার ছাত্ররা আছে, তারা অনেকে এখন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, ভালো লাগে। এগুলো আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। তাই আমি বার বার আমার ছাত্রদের কাছে হেরে যেতে চাই। আমি মনে করি, ছাত্রের কাছে হেরে যেতে পারাটাই আসলে জিতে যাওয়া।
আরও পড়ুন:
Comments