অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্ট

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক

ইলাস্ট্রেশন: এহসানুর রাজা রনি

বাংলাদেশে স্নাতক ডিগ্রীধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায় দেশের বেকার যুবকদের প্রায় ৪৬ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী।

উচ্চশিক্ষা বিষয়ে অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্সের ওপর পরিচালিত জরিপে এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, ‘সমাজের জন্য আমাদের একটি সার্টিফিকেট প্রয়োজন বলেই আমরা পড়াশোনা করছি। আমাদের পড়াশোনার বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে এমন খুব কম চাকরির ক্ষেত্রই বাংলাদেশে আছে। যার ফলে, চাকরির জন্য আলাদাভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।’

অপর এক শিক্ষার্থী জোর দিয়েই বলেন, ‘আমি মনে করি শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা চাকরির জন্য যথেষ্ট নয়; অ্যাকাডেমি থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তার বাইরে আরও অনেক কিছু জানার আছে।’

আধুনিক বিশ্বের নিত্য পরিবর্তিত প্রয়োজনীয়তা বোঝা এবং শিক্ষাকে বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতা থেকে দূরে সরিয়ে না নিয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অপরিহার্য। কর্মসংস্থানের সঙ্গে এর সম্পর্ক অপরিহার্য।

চাকরি প্রশ্নে, অবাক হওয়ার মতো হলেও একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী মনে করেন যে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদেরকে চাকরির বাজারের জন্য প্রতিযোগী করে গড়ে তুলতে পারছে ‘না’। তাদের অসন্তুষ্টির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এখানে আমরা একটি বিষয় সম্পর্কে কথা বলব, সেটি হচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা। প্রাসঙ্গিকতা বলতে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ফলাফল বর্তমান সময়ের জন্য কতটা উপযুক্ত তা বোঝায়। প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে জানতে হবে- ১. কোর্সের বিষয়বস্তু যুগোপযোগী কিনা, ২. অনুষদ সদস্যরা যুগোপযোগী কিনা, ৩. শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার তৈরির বিষয়ে শিখছে কিনা এবং ৪. অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম তার নির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত কিনা।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কীভাবে প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনা করা হয়?

৭ পয়েন্ট স্কেলে এর সামগ্রিক গড় স্কোর ৩ দশমিক ২৮। এটি স্পষ্টতই বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর জন্য অসন্তুষ্টির একটি জায়গা। মূলত, ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের ‘প্রোগ্রামের প্রাসঙ্গিকতা’র রেটিং দিয়েছে ৪ বা তার চেয়ে কম (যেখানে ৪ কে মোটামুটি সন্তোষজনক রেটিং বলে ধরা হয়)। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমসাময়িক শিক্ষা এবং শেখার সুযোগের অভাব থাকলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বে কীভাবে চাকরি খুঁজে নেবে, এই প্রশ্নটি স্বাভাবিক ভাবেই উত্থাপন হবে। বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে আগ্রহী। সেটা কীভাবে সম্ভব হবে, যদি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাসঙ্গিক জ্ঞানের মানব সম্পদ উৎপাদন না করে?

আলাদাভাবে হিসেব করলে প্রাসঙ্গিকতার দিক থেকে বিভিন্ন বিষয়ের যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষণীয়। যেখানে শিক্ষা কর্মসূচি পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯৮ পয়েন্ট, আপ-টু-ডেট কোর্স কন্টেন্ট ৩ দশমিক ১৬ পয়েন্ট, কর্মজীবনে সহায়ক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ পেয়েছে ৩ দশমিক ২৩ পয়েন্ট এবং শিক্ষকদের সমসাময়িকতা পেয়েছে ৩ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তুলনা

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে ৩ দশমিক ৭০ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ৩ দশমিক ১৯ স্কোর পেয়েছে। প্রাইভেট এবং পাবলিক উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দাবি করেন, তারা যে সমসাময়িক শিক্ষাগুলো গ্রহণ করছেন সেগুলো নিয়ে তারা ‘সন্তুষ্ট’ নন। মজার বিষয় হল, গড় স্কোরের ক্ষেত্রে প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্যটি পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ থেকে বোঝা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে অনেক বেশি অসন্তুষ্ট।

আরেকটি তুলনা, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার মান দিয়েছেন ৩ দশমিক ৬৪ এবং স্নাতক শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন ৩ দশমিক ১৪।

ব্যবসায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞান/প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাসঙ্গিকতার গড় রেটিং যথাক্রমে ৩ দশমিক ১৫ এবং ৩ দশমিক ৪১। এই পার্থক্য পরিসংখ্যানগত ভাবে উল্লেখযোগ্য নয়। তবে, এই পরিসংখ্যানটি দেখায় যে উভয় বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতে তাদের প্রতিষ্ঠান সমসাময়িক শিক্ষা দিতে পাড়ছে ‘না’। ব্যবসায় শিক্ষার ক্ষেত্রে ৩ দশমিক ১৫ রেটিং বেশ উদ্বেগজনক। কারণ ব্যবসায়িক বিষয়গুলো সাধারণত সমসাময়িক এবং ক্যারিয়ার-ভিত্তিক শিক্ষা বলে মনে করা হয়। এটা উদ্বেগজনক কারণ দ্রুত পরিবর্তনশীল ব্যবসায়ের পরিবেশে ব্যবসায়িক শিক্ষার শিক্ষার্থীরা তাদের বৈশ্বিক সমসাময়িকদের থেকে পিছিয়ে পড়বে।

তথ্য থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে আধুনিক বিশ্বের চাহিদা বোঝার গুরুতর ঘাটতি থাকতে পারে। যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাইরে থেকে জনবল নিয়োগ দেন তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়। কিন্তু তারপরও তারা এটা করছেন, কারণ স্থানীয়দেরকে কাজের জন্য প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে না তাদের কাছে।

বুয়েটের একজন শিক্ষক ফাতেমা তাসমিয়া বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় তত্ত্ব ও অনুশীলনের মিশ্রণ থাকা দরকার। শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান এবং পেশাদার জীবনের জন্য প্রস্তুত করার সময় এটা ভুলে গেলে চলবে না যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মনন বিকাশে কাজ করছে। আমাদের সেখানে ভারসাম্য রাখা দরকার।’

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মানের শিক্ষা প্রদান করে তা নিয়ে ক্রমাগত সমালোচনা চলছে। এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Dhaka University: Growing in size, shrinking in standard’ প্রবন্ধটি।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এগুলো কী কোনও বিশেষ অবদান রাখছে? শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উচ্চশিক্ষার অনেক প্রোগ্রাম আগের বছরের পুরানো পাঠ্যক্রমে অনুযায়ীই চলছে এবং এগুলো বিশেষ কিছু যোগ করতে পারছে না। এখন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে তাদের কোর্সগুলো পুনরায় সাজাচ্ছে। অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তাদের ফোকাসকে আরও বিস্তৃত করে এবং আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলানোর জন্য উপযোগী করে প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশের স্নাতক ডিগ্রীধারীরা ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়েছে। সেটা শুধুমাত্র বৈশ্বিক চাকরির বাজারেই না, দেশেও। বাংলাদেশেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য দেশ থেকে কর্মী নিয়োগ করছে, বিশেষত বড় পদগুলোতে। এখনই সময় পরবর্তী প্রজন্মকে সক্ষম করে গড়ে তুলতে সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম ডিজাইন করার।

 

ফাহমুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন ড. আন্দালিব। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে[email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনও প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

আরও পড়ুন: পড়াশোনায় আনন্দ ফেরাতে হবে

শিক্ষার্থীদের থেকে সবচেয়ে ভালোটা যেভাবে পেতে পারি

Comments

The Daily Star  | English

Lives on hold: Workers await reopening of closed jute mills

Five years on: Jute mill revival uneven, workers face deepening poverty

16h ago