সু চির ভাবনা-বিবেচনায় শুধুই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দেশ গঠন

অং সান সু চি। রয়টার্স ফাইল ছবি

মিয়ানমারে এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির ভাবমূর্তিতে যদিও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তবে, নিজ দেশের রাজনীতিকে ‘দুর্নীতিমুক্ত’ করার সফলতা তিনি জনগণকে ইতোমধ্যে দেখিয়েছেন। 

আল-জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৪১২টির ফল ঘোষণা করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩৪৬টি পেয়েছে সু চির দল এনএলডি। দেশটিতে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২২ আসন। এখনো ৬৪টি আসনের ফল ঘোষণা বাকি। 

‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমারের যে ভাবমূর্তি, এর বাইরে, মিয়ানমারকে ঠিকই একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ার কাজ করছেন অং সান সু চি। দৃশ্যমানভাবে মিয়ানমারের জনগণকে তিনি বোঝাতেও পেরেছেন যে, তিনি সেটা অনেকখানি করে ফেলেছেন এবং করছেন। সু চি মিয়ানমারের জনগণকে পাশে নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি করছেন। আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য কোনো রাজনীতি তিনি করছেন না। যেহেতু করছেন না, তাই রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে সু চি মোটেই চিন্তিত নন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সমস্যার যেমন সমাধান চাওয়া হয়, তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।’— দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথাই বলছিলেন কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান হিসেবে মিয়ানমারে গত প্রায় এক দশক ধরে কর্মরত শিহাব উদ্দিন আহমেদ

এবারের নির্বাচনেও সু চির জয়ের প্রেক্ষাপট, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ, দেশটির সামরিক শক্তি, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ এবং দেশটির গণমাধ্যম— এসব বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে শিহাব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

এবারও সু চি জেতার প্রেক্ষাপট বিষয়ে শিহাব উদ্দিন আহমেদের পর্যবেক্ষণ, ‘সু চির দলই যে জিতবে, সেটা ধারণা করা হয়েছিল। কারণ, সু চির দলের জনপ্রিয়তা এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন। কিন্তু, বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের যে ভাবমূর্তি, সেটি মূলত রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের যে আচরণ, সেটা দিয়ে। এর আগের নির্বাচনে যখন সু চির দল জিতে ক্ষমতায় এসেছিল, তখনো বলা হয়েছিল তাদের দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তারা কীভাবে দেশ চালাবে!’

‘কিন্তু, গতবারের নির্বাচনে জিতে যখন তারা দেশ পরিচালনা করল, তখন মিয়ানমারের জনগণের ভেতরে কয়েকটি জিনিস খুব পরিষ্কার হলো। প্রথমত, সু চি দলের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, তিনি নিজেও দুর্নীতি করবেন না, সরকারের মন্ত্রী বা কর্মচারীরাও কেউ দুর্নীতি করতে পারবেন না। কিংবা তার দলের নেতাকর্মীরাও কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বলতে যেটা বোঝায়, সু চি তার সরকারের ভেতর সেটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরও লক্ষণীয় বিষয়, তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন উপরের দিকে, নিচের দিকে না।’

এক্ষেত্রে সু চি কিছু দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন বলে জানান শিহাব উদ্দিন আহমেদ। যেমন: এই নির্বাচনের তিন মাস আগে থাইল্যান্ড বর্ডার সংলগ্ন দেশটির কাইয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন সু চি। তাকে বরখাস্তের কারণ— সেই মুখ্যমন্ত্রী তার আপ্যায়ন তহবিল থেকে বাংলাদেশি প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো নিয়ে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে উপহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, আপ্যায়ন তহবিল থেকে তিনি আরও কিছু অর্থ খরচ করেছিলেন, যেগুলো তার করার কথা নয়। শুধু এ কারণেই তাকে বহিষ্কার করেন সু চি।

আরেকটি দৃষ্টান্ত নিয়েও দেশটিতে আলোচনা হয়, যেটি নির্বাচনের বছরখানেক আগেকার। তেনেন্তরি রাজ্যের এক নারী মুখ্যমন্ত্রীকেও বরখাস্ত করা হয়। ওই নারী মুখ্যমন্ত্রীর দুই মেয়ের স্বামী অস্ট্রেলিয়ান। মেয়ের অস্ট্রেলিয়ান স্বামীদের কাজ দেওয়ার বিষয়ে এক ধরনের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আসে। অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বরখাস্ত করেন সু চি। ওই মুখ্যমন্ত্রী যে দুর্নীতি করেছিলেন, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। দুর্নীতির অভিযোগ এসেছিল, তার ভিত্তিতে এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কিছু বিষয় দৃশ্যমান হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়।

‘এই দুইটি ঘটনা মিয়ানমারের রাজনীতিতে খুব আলোড়ন তৈরি করে যে, সু চি দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছেন। কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। মিয়ানমারের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে যে, সু চি নিজেও দুর্নীতি করছেন না, কাউকেই করতে দিচ্ছেন না এবং দেশ তুলনামূলকভাবে ভালো চালাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে যেসব এলাকাগুলোতে গোলযোগ আছে, সেসব এলাকার এথনিক জনগোষ্ঠীও যে সু চিকে খুব বেশি অপছন্দ করেন, বিষয়টি তা নয়। সে কারণে তারাও এবার সু চিকে ভোট দিয়েছেন। ফলে রাখাইন রাজ্য ছাড়া অন্য সব রাজ্যেই সু চির দল ভালো করেছে’, বলছিলেন শিহাব উদ্দিন আহমেদ।

স্বর্ণ, তেল, গ্যাস ও কপারসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মিয়ানমার। শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশটিতে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল মূলত প্রথম দিকে, যখন সামরিক স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় ছিল। তারাই দুর্নীতিগুলো করেছে। কিন্তু, বর্তমানে মিয়ানমারের স্থানীয় রাজনীতিতে দুর্নীতির কোনো বিষয় নেই। অর্থাৎ সু চি মিয়ানমারের ভেতরে দেশটাকে খুব সুন্দরভাবে পরিচালনা করছেন। সেক্ষেত্রে দেশের ভেতর সু চির অত্যন্ত ইতিবাচক একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। কিন্তু, রাখাইনের রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চির ভাবমূর্তি অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।’

সু চির এবারের বিজয়ের পরে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সমাধান তিনি করবেন কি না? অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চি তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটা চেষ্টা করবেন কি না?

‘আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বা রাজনীতি নিয়ে সু চি মোটেই চিন্তিত বলে মনে হয় না। তার চিন্তা-ভাবনা বা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি নেই। তার মূল এজেন্ডা, যেটা তিনি তার দেশের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেটা হলো— তিনি তার দেশের রাজনীতি করবেন, দেশের রাজনীতি ঠিক করবেন, দেশের রাজনীতি, প্রশাসনকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত করবেন। তিনি নিজেও দুর্নীতি করবেন না, কাউকে করতেও দেবেন না। এই বিষয়টাই তিনি তার দেশের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একইসঙ্গে দেশের মানুষও মনে করছেন, সু চি যা করতে চাইছেন, সেটা তিনি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার বিষয়ে তিনি যেহেতু চিন্তিত না, সেই কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার ও দেশটির সামরিক বাহিনীর যে নীতি, এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরেও সেই নীতির সামান্যতম পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। মুখে যাই বলুক না কেন কিংবা বাংলাদেশকে যেই আশ্বাসই দেক না কেন।’

মিয়ানমারের শক্তির আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে— তারা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সদস্যভুক্ত দেশ। একইসঙ্গে চীনের সমর্থন মিয়ানমারের পক্ষে থাকা এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ মিয়ানমারে ব্যবসা করাটাও তাদের জন্য ইতিবাচক। ‘সু চির নীতি হচ্ছে— আমার সম্পদ আছে, আমাদের দেশে জমি আছে, ব্যবসার পরিবেশ আছে। সুতরাং আমাকে ইউরোপ বা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। যেহেতু আমাদের দেশের রাজনীতি ঠিক আছে এবং দুর্নীতিমুক্ত, তাই তারা আমার এখানে আসবে। ফলে দেশের বাইরে কাজ করে কিংবা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে, এটার কোনো কারণ সু চির রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে নেই। সর্বত্রই চীনের একক আধিপত্য আছে। কিন্তু, ভারতের প্রতিও মিয়ানমারের রাজনীতিবিদ ও জনগণের ইতিবাচক সমর্থন রয়েছে। এবারের রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর দিকে যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারে গিয়ে এই ইস্যুতে সরাসরি মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়, তখনই সেখানকার রাজনীতিবিদ, জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে ভারতের প্রতি কোমল অনুভূতি তৈরি হয়। আর তখন থেকেই ভারতও সেখানে কিছু কিছু ব্যবসা করছে’, বলেন শিহাব উদ্দিন আহমেদ।

রাষ্ট্র হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘তাদের সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে চীনের সমর্থন আছে, ইউরোপেরও সমর্থন আছে। কিন্তু, মিয়ানমারের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে বড় কারণ হলো— মিয়ানমারের সামরিক দিকের প্রধানতম পরামর্শদাতা ও সহায়তাকারী ইসরায়েল। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বেসামরিকদের ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণের একটা বড় অংশ ইসরায়েলে গিয়ে নিয়ে আসে বা ইসরায়েল মিয়ানমারে এসে দেয়। ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের যে কৃষি সাফল্য, সেই ক্ষেত্রের প্রযুক্তিগত সহায়তাও মিয়ানমার পায়। ফলে ইসরায়েলের সমর্থনে মিয়ানমারও কৃষিতে ভালো করছে।’

সবশেষে মিয়ানমারের গণ্যমাধ্যমের বিষয়ে শিহাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মিয়ানমারের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়, দেশটির গণমাধ্যম রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত— এগুলোর সবই সত্যি। কিন্তু, মিয়ানমারের একটা বড় দিক হলো— কিছু কিছু ক্ষেত্রে সু চি অনেক স্বচ্ছ আচরণ করেন। যেমন: পৃথিবীর কোন দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কী চুক্তি হলো, কোন দেশ মিয়ানমারকে কী সহায়তা দিলো, অর্থ দিলো, অস্ত্র দিলো, চুক্তি করল— এর সবকিছু জানানোর জন্য ডোনার অ্যান্ড এইড কো-অরডিনেশন ইউনিট (ডিএসিইউ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন সু চি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সু চি। এখানে কোন দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের কী চুক্তি হলো, কোন দেশ কী সহায়তা দিলো, সবকিছুই তারা অনলাইনে দিয়ে দেয়। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে সু চির সরকার অনেক স্বচ্ছ।’

‘মিয়ানমারের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো— তাদের কেউ চীনের পক্ষে বা কেউ ভারতের পক্ষে নয়। ভারত-চীনের কোনো পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপ নেই মিয়ানমারে। তারা সবাই মিয়ানমারের পক্ষে।’

আরও পড়ুন:

‘সেনাবাহিনী সুচির নীতি গ্রহণ করেনি, সুচি সেনাবাহিনীর নীতি গ্রহণ করেছে’

অধিকার আদায়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মিয়ানমারের নবনির্বাচিত মুসলিম পার্লামেন্ট সদস্য

Comments

The Daily Star  | English

Beyond development paradox & unnayan without democracy

As Bangladesh seeks to recalibrate its path in the aftermath of recent upheavals, the time is ripe to revisit an oft-invoked but under-examined agenda: institutional reform. Institutions are crucial to understand, as they are foundational for governance, transformation, and economic development.

16h ago