খাদ্য মজুদ অর্ধেকে নেমেছে
গত অর্থবছরে ব্যাপক ফলনের পরও সরকারের মজুদকৃত খাদ্যের পরিমাণ গত রোববার কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮ লাখ টনে।
খাদ্য মজুদ কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে ব্যর্থতা। এছাড়াও, চলমান মহামারি ও মহামারির মধ্যে কয়েক দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণের কারণে মজুদ কমে গেছে।
গত বছর ১ জুলাই সরকারের হাতে খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখ টন। এক বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৮ লাখ টনে।
দুই দিন আগে মজুদ আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮ লাখ টনে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের তথ্যে জানা গেছে, গত এক বছরে খাদ্য মজুদ অর্ধেক কমে গেছে।
দেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও সরকারি গুদামে মজুদ কমে গিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরে দেশে ধান ও গম উৎপন্ন হয়েছিল ৩ দশমিক ৭৬ কোটি টন। যা এর আগের অর্থ বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। অর্থবছর ২০১৯ এ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০ দশমিক ০৪ শতাংশ।
করোনার মধ্যেও দাম পাওয়ায় কৃষক উৎপাদনে আগ্রহী হয় বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন।
সরকারের খাদ্য সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল সরকার বোরো ধান ও চালের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম ধার্য করেছিল। অথচ, সে সময় খোলা বাজারে ধানের দাম ছিল বাড়তি।
খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৮ লাখ টন। কিন্তু, কিনতে পেরেছিল মাত্র ২ দশমিক ২ লাখ টন। তা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
সরকার ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্য নিলেও কিনতে পেরেছিল ৬ দশমিক ৮ লাখ টন। একইভাবে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্য নিয়ে কিনতে পেরেছিল ৯৯ হাজার টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয় কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে ২ লাখ টন ধান কেনার এবং মিল মালিকদের কাছ থেকে ৩৭ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই ধানের উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ২৭ টাকা ২৯ পয়সা এবং চালের খরচ কেজি প্রতি ৪০ টাকা ৩৬ পয়সা।
করোনা মহামারি ও কয়েকদফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ায় খাদ্যশস্য মজুদ কমেছে। গত অর্থবছরে সরকার চাল বিতরণ করেছে ২৭ দশমিক ৭৭ লাখ টন। এর আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৫ দশমিক ৯৪ লাখ টন।
এখন খাদ্য মজুদ বাড়ানো নিয়ে উভয়সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।
গত মাসে কৃষিমন্ত্রী মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, একদিকে ধানের দাম বাড়ানো কথা ভাবা হচ্ছে যাতে কৃষক ন্যায মূল্য পায়, আবার অন্যদিকে সাধারণ জনগণের কথা ভেবে দাম না বাড়ানোর কথাও চিন্তা করা হচ্ছে।
মহামারির কারণে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের আয় কমে গেছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা আরও বিপদে পড়েছেন।
গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে এটি সর্বোচ্চ। খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির এই রেকর্ড হয়েছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, মূলত চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যমূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, গত অক্টোবরে বাংলাদেশে মোটা চালের গড়পড়তা খুচরা মূল্য ছিল ৪৫ টাকা কেজি। তা গত বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি অন্য চালের দামও বেড়েছে।
করোনা মহামারির কারণে এই দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে খাদ্য আমদানির কথা ভাবতে হবে।
সূত্র জানায়, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে গত ২৮ অক্টোবর ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটির (এফপিএমসি) বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রণালয়কে দ্রুত ২ লাখ টন চাল কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, সরকারকে ৫ থেকে ৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে হতে পারে। আমন ধান কাটার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে ২ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
এই সংগ্রহ সরকারিভাবে করা হবে। সরকার চাল আমদানির ওপর শুল্ক কমাবে না। শুল্ক কমালে আমদানি বেড়ে যাবে।
মজুমদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘বেসরকারি আমদানিকারকরা গত এক বছরে কোনো চাল আমদানি করেননি। চাল আমদানির ওপর ৬২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।’
২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ টন, যার মধ্যে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার টন।
সরকারকে খাদ্য-ভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্যে খাদ্য মজুদ বাড়াতে হবে। দরিদ্রদের সহায়তার জন্যে খোলাবাজারে ভতুর্কিমূল্যে চাল বিক্রির কথা ভাবা হচ্ছে।
আবারও উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে আমন ধান কেনার প্রস্তুতি চলছে বিধায় সরকার এবারের সংগ্রহে সফল নাও হতে পারে।
গত ২৮ অক্টোবর এফপিএমসি গতবারের মতো আমন ধানের কেজি ২৬ টাকা ধরে দিয়েছে।
গতকাল চিত্ত মজুমদার বলেন, ‘কৃষকরা তাদের সদ্য কাটা ধান স্থানীয় বাজারে আনতে শুরু করেছেন।’
তার মতে, গত বছরের তুলনায় এ বছর আমনের ফলন কম হয়েছে। তাই ধানের বাজারমূল্য চড়া।
তিনি আরও জানিয়েছেন, গুটিস্বর্ণা নামের মোটা ধান বগুড়ার শেরপুরে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা মণ দরে। গত বছর এই ধানের দাম ছিল মণ প্রতি ৭০০ টাকা।
মধ্যম ও চিকন চালের ধানের দামও উর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছেন চিত্ত মজুমদার।
সরকার গত চলতি মৌসুমে আমন চাল সংগ্রহ ৬ লাখ টন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত মৌসুমে এ সংগ্রহ ছিল ৩ দশমিক ৮ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় এ বছর চালের দাম কেজি প্রতি এক টাকা বাড়িয়ে ৩৭ টাকা ধরা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে খাদ্যসচিব নাজমানারা খানম মাঠ পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমনের ব্যাপক ফলন হয়েছে।’
তিনি চারটি জেলা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার উৎপাদন পরিস্থিতি জেনেছেন। বলেছেন, ‘উৎপাদন ভালো হলে বিদেশ থেকে কিনতে হবে না।’
মজুদ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় শস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি বলেই এমনটি হয়েছে। ‘বাজারমূল্য বেশি ছিল আর আমরা সেই তুলনায় কম মূল্য নির্ধারণ করেছিলাম,’ যোগ করেন তিনি।
Comments