সক্ষমতার চেয়ে কথা বেশি
গত কয়েকদিনে দেশে করোনার সংক্রমণ কিছুটা বাড়লেও রাস্তাঘাটে চলাফেরায় মানুষের মাঝে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানা তো দূরের কথা, মাস্কও পরার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয় না। জনসাধারণের মাস্ক পরাসহ তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কঠোর হতে যাচ্ছে সরকার। জনগণের মাঝে অসচেতনতা তো আছেই, কিন্তু, এক্ষেত্রে সরকারের আরও আগেই কঠোর হওয়া উচিত ছিল বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দেশে করোনার সংক্রমণের শুরু থেকেই সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। যা এখনো দৃশ্যমান। পাশাপাশি করোনার ভ্যাকসিন পেতে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, সেটা অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই করেছে বলে মনে করছেন তারা। এক্ষেত্রে আরও অপেক্ষা করা দরকার ছিল বলে তারা জানিয়েছেন। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন সংরক্ষণের বিষয়েও বাংলাদেশের আরও তৎপর উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি কেমন, মাস্ক পরা নিয়ে যে তৎপরতা এখন শুরু হলো, তা আরও আগে থেকে শুরু করা দরকার ছিল কি না, ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিনের যে অগ্রগতি, সেই তুলনায় অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কোন পর্যায়ে আছে, অ্যান্টিবডি টেস্ট না করে কীভাবে ১৭ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব, ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে কি না— এসব বিষয়ে তিন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
বর্তমানে দেশে করোনার সংক্রমণ একটু একটু বাড়ছে বলে উল্লেখ করে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘গতকালও বাড়ল। সামনে শীত, তাই করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে। তবে, মূল কথা হলো— মানুষ কোনোক্রমেই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। কেউই মানে না। মাস্ক পরে না, হাত ধোয়ার চর্চা কারো নেই, শারীরিক দূরত্ব মানছে না, মানুষের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক কেটে গেছে। রাস্তা-ঘাটে চললে তো মনেই হয় না যে দেশে করোনা আছে। কাঁধের ওপর কাঁধ দিয়ে সবাই চলাফেরা করছে। এমনকি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগেও একই অবস্থা। কোনো দূরত্ব মানা হচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকাতেই যেই অবস্থা, আর ঢাকার বাইরের তো কোনো খবরই নেই। মাস্ক পরে না, জানে না, বোঝে না। সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, “করোনা বলে কিছু নেই”। সর্বত্র গা-ছাড়া ভাব। শুধু আমাদের এখানেই নয়, এটা পৃথিবীব্যাপীই। আমাদের জীবনযাত্রা তো এখন স্বাভাবিক। বাস, ট্রেন, লঞ্চসবই তো আগের মতো চলছে। এসব কারণেই সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়েছে।’
মাস্ক পরা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আরও আগে থেকে তৎপরতা শুরু করা দরকার ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিসের সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে, শুধু তো আইন দিয়ে তো হবে না, মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। এখন দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব আইন প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রয়োজনে সর্বস্তরের মানুষকে কাজে লাগাতে হবে। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, তারকা, গ্রামেগঞ্জে এমপি বা অন্যান্য নেতারা, তাদের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে টিভি, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াগুলোকেও কাজে লাগাতে হবে।’
ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার তুলনায় অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার বিষয়ে অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আসলে কার্যক্ষমতা নিয়ে এখনো কোনো বাস্তবিক প্রমাণ তো আমরা পাইনি। সবাই তো যার যারটা ভালোই বলবে। বাস্তবতা হলো আমাদেরকে আরও কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাচাই করতে হবে। ভ্যাকসিন বাজারে আসুক, চলুক, এরপর দেখলে বোঝা যাবে। যাদের ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা যতই হোক না কেন, চূড়ান্ত অনুমোদন তো কোনোটারই এখনো হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদন হবে, এরপর উৎপাদন হবে, এরপর জনগণ পেলে সঠিক কার্যকারিতা বোঝা যাবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা তো আমাদের কারোরই নেই। তারা যেটা বলছে, সেটাই শুনছি। তাই তাড়াহুড়ো না করে আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করা দরকার।’
অ্যান্টিবডি পরীক্ষা ছাড়াই দেশের সব মানুষকে ধীরে ধীরে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব বলে মনে করেন দেশের প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট জনগণকে একবারে তো ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব না। গুরুত্ব অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে আনতে হবে। কিন্তু, অ্যান্টিবডি টেস্ট না করেও ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। কারণ, অ্যান্টিবডি যেটা তৈরি হয়, সেটা তিন মাসের বেশি থাকে না। সুতরাং অ্যান্টিবডি পরীক্ষা না করেও ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই।’
ভ্যাকসিন সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনাটা খুবই জরুরি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই এটা বলছিলাম। শুধু ভ্যাকসিন আনলেই তো হবে না। এটার জন্য ফ্রেমওয়ার্ক থাকতে হবে। আনার পর সংরক্ষণ করা, অন্যান্য বিষয়গুলো ঠিক করা, প্রয়োজনীয় মানবশক্তি তৈরি করা— এগুলো তো করতে হবে। এরপর এগুলো ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা। কারণ ভ্যাকসিন তো শুধু শহরে নয়, গ্রামেও যাবে। ভ্যাকসিন যেই পরিবহনে নেওয়া হবে, সেখানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে তো এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। এগুলো এখন থেকেই ঠিক না করলে ভ্যাকসিন আনার পর হযবরল অবস্থা হবে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। এই সক্ষমতা অর্জনের পর ভ্যাকসিন আনতে হবে। শুধু তাড়াহুড়ো করে ভ্যাকসিন আনা হলো, এনে ঠিক রাখতে পারল না, তাহলে তো হবে না।’
‘ভ্যাকসিন নিয়ে তো আমাদের সুনাম আছেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন হিরো উপাধি পেয়েছেন। আমি মনে করি, করোনা ভ্যাকসিন আনার পর সেটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের চলছে। আর যদি এখনো কাজ শুরু না করা হয়, তাহলে আগে করে এরপর ভ্যাকসিন আনতে হবে’, যোগ করেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ।
আমাদের দেশে যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনটা শুরু হয়েছিল, সেটা এখনো দেশব্যাপী চলছে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের করোনা পরিস্থিতি ইম্প্রুভ করছিল। আমাদের সংক্রমণের হার প্রায় ১০ এর কাছাকাছি নেমে এসেছিল। কিন্তু, সেই সংক্রমণটা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আগেই আবার সংক্রমণটা বাড়তে শুরু করেছে। আমরা করোনার প্রভাব বিস্তার রোধ করতে পারিনি, এটা আবার বাড়ছে।’
মাস্ক পরা নিয়ে তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমি বলে এসেছি, স্বাস্থ্যবিধি মানা আর মানানো— দুটো ভিন্ন বিষয়। ডব্লিউএইচও প্রথম থেকেই বলছে যে, কমিউনিকেশন এবং কমিউনিটি এনগেজমেন্ট। তার মানে স্বাস্থ্যবিধি যেটা আছে, এটা সচেতনতার জন্য। পাশাপাশি কাজ হলো উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করা। এখন আমরা যেটা করেছি, সেটা হলো— সচেতন করা। সচেতন করতে গিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এটাই হলো সচেতনতা। আমরা মানুষকে সচেতন করেছি ঠিকই। কিন্তু, তাদের উদ্বুদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে পারিনি। কিন্তু, এই কথাটাও ডব্লিউএইচও প্রথম থেকেই বলেছিল। এখন মাস্ক পরার বিষয়ে জনগণ সচেতন। কিন্তু, সঠিক মাস্ক পরা, কখন মাস্ক পরতে হবে, এই বিষয়গুলোতে জনগণের মধ্যে যে শিথিলতা, এই শিথিলতা থাকবেই। সবদেশেই কিছু লোক থাকে যারা এগুলো মানে না। এখন যারা মানে না, তাদের মানানোর দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে যারা মানছে না তাদেরকে মানাতে হবে। যারা বলতে এখানে শুধু ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানও। সেই জায়গায় জনগণ যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে শিথিলতা দেখাচ্ছে, রাষ্ট্রও কোনো কঠোর অবস্থান নেয়নি। তারাও শিথিলতা দেখিয়েছে মানানোর বিষয়ে। যে কারণে সংক্রমণ কমা শুরু করলেও এখন আবার বাড়া শুরু করেছে।’
অক্সফোর্ডে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার যথাযথ ফলাফল এখনো আসেনি উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘মডার্নার কার্যকারিতা ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ফাইজারের ৯০ শতাংশ। সেখানে অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিষয়ে আমরা এখনো কিন্তু নিশ্চিত নই যে তাদের কার্যকারিতার হার। যেটা আমরা ইতোমধ্যে চুক্তি সই করে বসে আছি। পাশাপাশি এটা অ্যাস্ট্রাজেনেকা দিচ্ছে তিন ডলারে। আমাদের কাছে যা খবর, সেটা হলো পাঁচ ডলারে কিনতে হবে। এখানে প্রথম কথা হলো আমাদের চুক্তিটা তড়িঘড়ি করে করা হয়েছে। এই চুক্তিটা করার সঠিক সময় এখনো আসেনি। আমাদের তিনটা জিনিস দেখতে হবে। প্রথমত মানসম্মত কোয়ালিটি, দ্বিতীয়ত কার্যক্ষমতা, তৃতীয়ত মানব শরীরের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ কি না। এই তিনটা বিষয়ের জন্য যে ভ্যাকসিনটা ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাবে এবং পরবর্তীতে মার্কেটিংয়ের অনুমোদন পাবে, এই দুটার পর তৃতীয়ত দেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন। আমাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন যে, দেশের মানুষের শরীরে এটি ব্যবহার করা যাবে কি না। এই তিনটার কোনোটা হওয়ার আগেই আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তিটা করেছি। এটা করা সরকারের উচিত হয়নি। কারণ, আমি ওই ভ্যাকসিনটাই কিনব, যেটা ওই তিন অনুমোদন পেয়েছে।’
অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে ডব্লিউএইচওর সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমি যেটা বলে আসছি, আমাদের র্যাপিড অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কথা। অ্যান্টিবডি পরীক্ষাটা দুটো কাজ করে। প্রথমত ডায়াগনোসিস। এটা ডায়াগনস্টিক টেস্ট। কিন্তু, চিকিৎসার জন্য পিসিআর দিয়ে নিশ্চিত হতে হয়। একজনের শরীরে অ্যান্টিবডি হচ্ছে, তার মানে তিনি আক্রান্ত। অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে ও লক্ষণ নেই, তার মানে তিনি আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গেছেন। যে কারণে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। এখন এটার জন্য “সেরো সার্ভিলেন্স” দরকার। মানে প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, এলাকায় আমাদের কতজন মানুষ আক্রান্ত হয়ে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি হয়েছে, সেটা জানা দরকার। আমরা যদি এটা জানতে পারি, তাহলে আমাদের ভ্যাকসিনের প্রয়োজন কত, সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারব। সুতরাং আমাদের একটা স্ট্র্যাটিজিক পরিকল্পনা যে, আমাদের কী পরিমাণ ভ্যাকসিন লাগবে, সেটা আমরা কীভাবে পাব, কতদিনের মধ্যে পাব, এই কৌশলটা সরকারকে আগে ঠিক করতে হবে। এই কৌশল ঠিক না করে ভ্যাকসিনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সরকারে ঠিক হচ্ছে না। তবে, যারাই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করবে, তাদের সঙ্গে আমরা নেগোশিয়েট করতে পারি এখন থেকেই। সেটা যেনো একাধিক ভ্যাকসিন হয়।’
ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে সরকারের আরেকটা ভুল হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার সংরক্ষণ, মডার্নার সংরক্ষণ আর ফাইজারের সংরক্ষণ, এই তিনটা ভ্যাকসিন নিয়ে যে কথা হচ্ছে, এই তিনটা সংরক্ষণের বিষয়টি আলাদা। কোনো কোনো ভ্যাকসিন আমাদেরকে মাইনাস ৮০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করতে হবে। কোনোটি মাইনাস ২০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করতে হবে। আবার কোনো কোনো ভ্যাকসিন আমাদের যে বর্তমান ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থার মধ্যে আমরা সংরক্ষণ করতে পারব। এক্ষেত্রেও আমরা কোন ভ্যাকসিনটা আনব, তাদের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া কী, সেই জিনিসগুলো জেনে আমাদেরকে ভ্যাকসিনটা কিনতে হবে। কারণ, যেই ভ্যাকসিনটা কেনা হবে, সেটা সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের আছে কি না, সেটা তো দেখতে হবে। একটা ভ্যাকসিন আমরা কিনে ফেললাম, অথচ সেটা সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের নেই, যেটা অ্যাস্ট্রাজেনেকার বেলায় হয়েছে। সেটা সংরক্ষণের জন্য আমাদের সেই ব্যবস্থা নেই। অথচ আমরা যদি ফাইজার বা মডার্না কিনি, তাহলে সেটা সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য সহজ। কারণ কম মাইনাস ডিগ্রিতে যেগুলো সংরক্ষণ করা যায়। মোদ্দা কথা, ভ্যাকসিন কেনার আগে আমাদেরকে নীতি ঠিক করতে হবে যে, কোন ভ্যাকসিনটা বাংলাদেশের জন্য অ্যাফোরডেবল হবে, যেটা মানসম্মত, কার্যক্ষমতা আছে, ঝুঁকিপূর্ণ নয়, আমরা শুধু সেটাই কেনার সিদ্ধান্ত নেবো। আমাদের সংরক্ষণের সক্ষমতাটা দেখতে হবে।’
‘এখানে তাড়াহুড়ো করলে হবে না। ভ্যাকসিন তো ওষুধ না যে, এটা দিলেই আমরা করোনামুক্ত হয়ে যাব। আমাদেরকে করোনা নিয়েই চলতে হবে অনেক বছর। যতদিন না পর্যন্ত এটা ওষুধ আবিষ্কার না হবে। সে জন্যই আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। জনসাধারণ যাতে সেটা মানে এবং পাশাপাশি সরকার যাতে মানায়। এ বিষয়ে সরকারে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে’, বলেন অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক।
দেশে করোনার সংক্রমণের প্রথম তরঙ্গ শেষ না হতেই দ্বিতীয় তরঙ্গ দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘আমাদের তো এখনো প্রথম তরঙ্গটাই শেষ হয়নি। এর মধ্যেই গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ বেড়েছে। করোনার সংক্রমণ রোধে আমরা চেষ্টা করি নাই, তা বলব না। কিন্তু, আমাদের চেষ্টাটা তো দুর্বল চেষ্টা ছিল। কার্যকর চেষ্টা তো ছিল না। সেটা জনগণের পক্ষ থেকেও না, সরকারের পক্ষ থেকেও না।’
আমাদের এখানে অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হয় না বলেই মনে করেন অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে অব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত হয়তো নেয়, কিন্তু, সেটার বাস্তবায়ন আর হয় না। এখানে শুধু সরকারের বিষয়টি দেখলে হবে না। জনগণকেও আমরা সচেতন করতে পারিনি। সেখান থেকে ব্যর্থতা দুই পক্ষেরই রয়েছে। ফলে এই যে জনগণ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না— এর ব্যর্থতা উভয়েরই।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন তো ইতোমধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট তৈরি করে ফেলেছে। এখন দরকার ডব্লিউএইচওর অনুমোদন। তাদের প্রস্তুতি পর্ব তো শেষ।’
কাদের ভ্যাকসিন লাগবে, সেটা দেখার জন্য সেরোলজিকেল পরীক্ষা দরকার বলে উল্লেখ করে বিএমএ’র সাবেক সভাপতি বলেন, ‘আইসিডিডিআর,বি যেটা করেছে, সেটা তো ছোট স্টাডি। সেই জায়গাটাতেই তো আমাদের দুর্বলতা রয়ে গেছে। আর শতভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে তো অনেক সময় লাগবে। এখন সরকার ভ্যাকসিন আনলে সেরোলজিকেল পরীক্ষা করে সেটা দেবে কি না, সেটাও আমরা জানি না। মানে নীতিটা কী, সেটা আমরা জানি না। ভ্যাকসিন আনার পরের প্রক্রিয়া নিয়ে তো একটা ফ্রেমওয়ার্ক দরকার। সেটা কী হবে, সরকার তো সেটা প্রকাশ করেনি। এই তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনার পরের প্রক্রিয়াটা কী হবে? সেটা তো আমরা জানি না। সেই মার্চেই বলেছিলাম, সরকার যে পরিকল্পনা করছে, সেটি সঠিক নয়। এখনো সঠিক পরিকল্পনা নেই। এই মাঝেমধ্যে আসে, মাঝেমধ্যে চলে যায়। সবকিছু স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সবাইকে জানানো উচিত ছিল। জানি না। মিটিং হচ্ছে, দেখি তারা কী করেন।’
‘আরও দুটো ভ্যাকসিন আছে, চীনের ও রাশিয়ার। তারা তো সেগুলো তাদের দেশে প্রয়োগ করা শুরু করেছে। কিন্তু, চীনেরটা আমাদের এখানে ট্রায়াল করল না। রাশিয়া বোধহয় চেষ্টা করছে আমাদের এখানে একটা ট্রায়াল দেওয়ার’, বলেন তিনি।
ভ্যাকসিন সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটো বিষয়। প্রথমত ভ্যাকসিন দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া তো আমাদের আছেই। দ্বিতীয়ত এটা যেহেতু আনবে বেক্সিমকো, স্টকিংটা তো তাদের করতে হবে। এখানে বিষয় হচ্ছে সেরাম ইনস্টিটিউট কীভাবে ভ্যাকসিনটা দেবে এবং বেক্সিমকো কীভাবে এখানে এনে রাখবে, এরপর সেখান থেকে সরকারকে সরবরাহ করবে। এখন সরবরাহের সেই প্রক্রিয়াটা সেটা ভালো হোক, মন্দ হোক, আমাদের যেহেতু ইমিউনাইজেশন প্রক্রিয়াটা আছে, এটা বোধহয় আমাদের আছে। তাও যে প্রস্তুতি, অর্থাৎ যে ব্যবস্থাটা আছে, সেটা পুনরায় খতিয়ে দেখা, সেটা করতে হবে। আবার ভ্যাকসিন কাদেরকে, কীভাবে দেওয়া হবে, সেটাও একটি বিষয়। এটা আসলে নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। এখন সেই প্রক্রিয়াটা তো আমি বলতে পারব না। সেটা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন।’
Comments