পুনর্বাসন কেন্দ্রের পুনর্বাসন প্রয়োজন
‘কৌতূহলী’ হয়েই মোহাম্মদ লিমন (ছদ্মনাম) প্রায় দুই দশক আগে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম গাঁজা সেবন করেন। এরপর তিনি নিয়মিতই এই নেশা দ্রব্যটি সেবন শুরু করেন এবং আসক্ত হয়ে পড়েন।
কয়েক বছর গাঁজার নেশায় ডুবে থাকা লিমন পরবর্তীতে হিরোইন এবং শেষ পর্যন্ত ইয়াবায় মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। তার বাবা-মা তাকে বেশ কয়েকবার ঢাকা ও গাজীপুরের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করান।
এসব কেন্দ্রে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা লিমনের মনে গভীর দাগ ফেলেছে। তার ভাষায়, তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে এবং মনে হয়েছে তিনি একজন ‘অপরাধী’।
লিমন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মারধর করা, ঘুষি দেওয়া এবং শাস্তি হিসেবে না খাইয়ে রাখা বা ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসা পদ্ধতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসক্তির কারণে অস্থির হয়ে উঠলে হাসপাতালের কর্মীরা আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতেন এবং ঘুষি মারতেন। মাঝে মাঝে এই অমানবিক আচরণ সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। এখনো সেই দুঃস্বপ্ন আমাকে তারা করে বেড়ায়।’
দেশের অনেক বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি লিমনের কথায় উঠে এসেছে। দ্য ডেইলি স্টার এমন ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের সবারই অভিজ্ঞতা প্রায় একইরকম।
২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত ছিলেন।
দেশের ৩৫১টি আবাসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রের মধ্যে ১০৫টি ঢাকা মহানগরের ভেতরে রয়েছে বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
দেশের ২০টি জেলায় কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই।
ডিএনসি সূত্র জানায়, ঢাকার মাইন্ড এইড হাসপাতালের মতো কেন্দ্রগুলোসহ দেশে মোট পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ২০০ এর কাছাকাছি হতে পারে।
তাদের মধ্যে অনেকেরই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং নার্স নেই। ২০০৫ সালের ২ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী যা বাধ্যতামূলক।
দায়িত্বরত সরকারি বিভাগ ডিএনসির যথাযথ নজরদারি না থাকায়, কেন্দ্রগুলো অদক্ষ জনবল দিয়ে পরিচালিত হয়। ফলে অনেক রোগী চিকিৎসা নেওয়ার পরও পুনরায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পুলিশের তথ্য অনুসারে, গত তিন বছরে সারাদেশে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো থেকে অন্তত ১৭টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
সম্প্রতি মাইন্ড এইড হাসপাতালে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যু এই বিষয়টিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন কর্মচারী তাকে বেধড়ক মারছে এবং তার দেহ নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে মারধর করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে, আনিসুল করিম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
‘নামভিত্তিক সংগঠন’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোই ‘নামভিত্তিক সংগঠন’ এবং তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত কর্মী এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে।
জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ পুনর্বাসন কেন্দ্রই পুনর্বাসন কেন্দ্র নয়। এই কেন্দ্রগুলোতে আসা রোগীদের হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে তালাবন্ধ কক্ষে রাখা হয়। এটি চিকিত্সা নয়, এটি অবমাননা।’
অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেন্টিং ড্রাগ এবিউজের সভাপতি ডা. অরূপ জানান, মাদকাসক্ত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র বেড়ে যাচ্ছে।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিজমি আক্তার (ছদ্মনাম) উত্তরার একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার ইয়াবার প্রতি আসক্তি নিরাময়ের চিকিত্সার অভিজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, ‘আমি একটি ছোট ঘরে ছিলাম। আমি যখন ইয়াবার জন্য অস্থির হয়ে উঠতাম তখন তারা আমাকে ঘুমের ওষুধ দিতো। কিন্তু আমি খেতে না চাইলে আয়া ও নার্সরা আমাকে মারধর করতো। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।’
একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযানের সময় ডিএনসির এক কর্মকর্তা যা জানতে পারেন, তা আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেই অভিযানে আমরা একজন ওয়ার্ড বয় পাই, যার এর আগে কখনো কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এবং প্রশিক্ষণও নেই। তার চাচা তাকে চাকরি করার জন্য সেখানে নিয়ে আসেন।’
তিনি জানান, পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো ভর্তি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী পুরুষ ও নারীদের নিয়োগ দেয়। প্রায়শই তাদের বাউন্সার নামে ডাকা হয়।
বাউন্সাররা একটি পেশাদার গ্রুপ, যারা নাইটক্লাব বা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকে।
‘এটি রোগ, অপরাধ নয়’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেখালা সরকার মনে করেন, মানুষের মধ্যে মাদক চিকিৎসা সম্পর্কে বোঝার ভুল রয়েছে। মাদকাসক্তদের একটি স্বাস্থ্যকর এবং অর্থবহ জীবনের দিকে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। এটি রোগ, অপরাধ নয়। আমাদের প্রথমে এই কথাটি বুঝতে হবে। মাদকাসক্ত রোগীর চিকিত্সা করার জন্য অত্যন্ত সুসংহত এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োজন।’
একজন সাধারণ নার্স বা ওয়ার্ড বয় মাদকাসক্ত রোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, কেননা রোগীরা মাঝে মাঝে হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ বিষয়ে পেশাদারদের খুঁজে পাওয়াও একটি চ্যালেঞ্জ বলে যোগ করেন তিনি।
‘সমাজ কী বলবে, এমন চিন্তা থেকে অনেকেই এই চাকরি নিতে উত্সাহী হন না। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে রোগীদের সঙ্গে পরিবারের কাউকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে শুধু হাসপাতালের কর্মীদেরই রোগীদের সঙ্গে থাকতে হয়, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ভাগ্যক্রমে, তারা এর জন্য বাড়তি কোনো ইনসেনটিভ পান না। তাই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষ পেশাদার পাচ্ছি না’, বলেন মেখালা সরকার।
পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন ডিএনসির সাবেক মহাপরিচালক বজলুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ডিএনসির কাছে যথেষ্ট জনবল রয়েছে এবং তারা যদি কোনো অনিয়ম করে, তাহলে ডিএনসি ব্যবস্থা নিতে পারে।’
যোগাযোগ করা হলে ডিএনসির পরিচালক মো. নুরুজ্জামান শরীফ জানান, তারা ইতোমধ্যে সব পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সেগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। যারা নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা খুব শিগগির পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর মালিকদের সঙ্গে বসতে চাই একটি কঠোর বার্তা দিতে। তা হলো, রোগীদের কোনো ধরণের শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং যদি এমন কোনো অভিযোগ যদি পাওয়া যায়, তবে কেন্দ্রগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’
Comments