মাধ্যমিকে আলাদা বিভাগ না থাকা, দুই শিক্ষাবিদের ভাবনা

২০২২ সাল থেকে চালু হওয়া মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের মতো আলাদা বিভাগ থাকছে না। অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণিতেও শিক্ষার্থীরা একটি বিভাগের আওতায় পড়াশোনা করবে। সব শিক্ষার্থীই সব ধরনের শিক্ষা নিয়ে ১০ বছর পড়বে। গত ১৯ নভেম্বর সংসদের অধিবেশনে বিষয়টি জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী।

২০২২ সাল থেকে চালু হওয়া মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের মতো আলাদা বিভাগ থাকছে না। অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণিতেও শিক্ষার্থীরা একটি বিভাগের আওতায় পড়াশোনা করবে। সব শিক্ষার্থীই সব ধরনের শিক্ষা নিয়ে ১০ বছর পড়বে। গত ১৯ নভেম্বর সংসদের অধিবেশনে বিষয়টি জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য যথার্থ কি না; নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী কেউ বিজ্ঞান পছন্দ না করলেও তাকে গণিত পড়তে হবে কিংবা কেউ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলেও তাকে ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের বিষয় পড়তে হবে; আবার বিজ্ঞানে আগ্রহী একজন শিক্ষার্থীকে অন্য বিষয় পড়তে হলে তো বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয় ছাড় দিতে হবে; সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীরা কি এতে উপকৃত হবে নাকি এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে— এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ঢাবির সাবেক উপাচার্য ও ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন না রাখার এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিকে এই বিভাজন খুব কার্যকর হয় না। ওই লেভেলে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে, কোন স্ট্রিমে তারা যাবে। অনেক সময় অভিভাবকদের চাপে চলে যায়। কিন্তু, পরে বুঝতে পারে যে, সেটা তার জন্য যথার্থ নয়। কিন্তু, তখন আর তার ফেরার কোনো পথ থাকে না। তাই আমার মনে হয় এটা ভালো সিদ্ধান্ত। আসলে এটা না থাকাই ভালো ছিল। এখন থাকায় তুলে দিচ্ছে এবং সেটা ভালো পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।’

‘ইন্টারমিডিয়েটে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেবে যে কোন বিভাগে যাবে। এর আগে একটা জেনারেল এডুকেশন থাকা দরকার। যার মাধ্যমে তারা সবকিছু সম্পর্কে জানবে এবং অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে ইন্টারেকশন করতে পারবে’, বলেন তিনি।

এ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী কেউ বিজ্ঞান পছন্দ না করলেও তাকে গণিত পড়তে হবে কিংবা কেউ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলেও তাকে ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের বিষয় পড়তে হবে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বাছাই করার সুযোগ থাকা দরকার। অর্থাৎ অপশনাল বিষয় থাকা দরকার। মানে একই স্ট্রিমে সবাই পড়বে। কিন্তু, এর মধ্যে পছন্দ থাকা যে, শিক্ষার্থী তার আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে সাবজেক্ট নেবে। এই অপশনটা থাকা দরকার।’

সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানে আগ্রহী একজন শিক্ষার্থীকে অন্য বিষয় পড়তে হলে তো বিজ্ঞানের কোনো একটি বিষয় ছাড় দিতে হবে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেক্ষেত্রে অপশন থাকলে শিক্ষার্থী পছন্দমতো গণিত বা যেটা হোক নেবে। কিন্তু, মাধ্যমিকে ওই বিভাজনটা না থাকাই ভালো বলে আমি মনে করি। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীর জেনারেল এডুকেশন থাকা দরকার। জেনারেল এডুকেশনের পরে স্পেশালাইজড করবে।’

‘সব বিবেচনায় আলাদা বিভাগে যাওয়ার বিষয়টি স্কুল লেভেলে না করে কলেজ লেভেলে করাটাই ভালো বলে মনে করছি। স্পেশালাইজেশনটা নবম শ্রেণিতে না করে ইন্টারমিডিয়েটে গিয়ে করবে’, বলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

আগে যখন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা ছিল, তখনো মাধ্যমিকে কোনো বিভাগ বিভাজন ছিল না বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘এক কথায় বলতে গেলে এই সিদ্ধান্তটা ভালো। কারণ, এসএসসির আগেই শিক্ষার্থীদের আলাদা স্ট্রিমে নিয়ে পড়ানোর কারণে কিছু কমন সাবজেক্ট যেগুলো একজন শিক্ষার্থীর স্কুল লেভেলে পড়া উচিত, সেগুলো যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে পড়া হতো না। যেমন: বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ ও সভ্যতার ইতিহাস, দেশসহ সারা বিশ্বের ভূগোল এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হতো না। আবার সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে হতো না। তাতে দেখা গেল, মাধ্যমিকের এই বিভাগ বিভাজনটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি নির্দিষ্ট স্ট্রিমে পাঠানোটা খুব আগে হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকে গ্রুপ সিটিজেন হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে, বর্তমান সমাজ-সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিষয়ই দরকার হয় যেগুলো স্ট্রিমিংয়ে পড়ানো হয় না।’

‘এখন যদি মাধ্যমিকে এই বিভাজনটা করা না হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভাষা, গণিতের, সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ও সাহিত্য— সবই পড়ানো হবে। বিশেষ করে যারা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, তারা তো খুব বেশি সাহিত্য পড়ে না বা পড়া হয় না। আমার বিশ্বাস বিভাজন বাদ দেওয়ার মাধ্যমে এখন শিক্ষার্থীদেরকে সাহিত্য, ইংরেজি-বাংলা ভাষা, গণিত, ভূগোল, সামাজিক বিজ্ঞান, দর্শন পড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। ফলে এসএসসি পাসের সময় একজন শিক্ষার্থী যতটুকু পারা যায় সব রকমের জ্ঞান নিয়ে বের হবে। এই বিভাজনটা ইন্টারমিডিয়েটে করলেও কোনো ক্ষতি হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে তো দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তই কোনো বিভাজন নেই।’

মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা যৌক্তিক বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তবে, শুধু সিদ্ধান্তটা নিলে তো হবে না। আমরা তো অনেক কিছুরই সিদ্ধান্ত নেই, সিলেবাসে অনেক কিছুই থাকে। কিন্তু, পড়ার বেলায় কতটুকু পড়ানো হয়, কতটুকু কাভার দেওয়া হয়, সেটা বড় কথা। ভালো এই সিদ্ধান্তটার সঙ্গে ডেডিকেটেড ও যোগ্য শিক্ষকও যোগ হতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা শিখবে। অন্যথায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাটা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারবে না বা শিক্ষক সেটা দিতে পারবেন না। ফলে অবশ্যই এটা ভালো সিদ্ধান্ত। তবে, এর জন্য শিক্ষক কমিউনিটিকে উন্নত করতে হবে।’

বিজ্ঞান পছন্দ না করা কারো গণিত পড়া বা বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাওয়া কারো ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের বিষয় পড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য। যদি কমন স্ট্রিম হয়, তাহলে সবাইকেই গণিত যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। এখনকার স্ট্রিমে আর্টসের শিক্ষার্থীদের হয়তো গণিত তেমন গুরুত্ব না দিলেও হয়। কিন্তু, এটা কোনো যৌক্তিক বিবেচনা না। কারণ, আজকের যুগ-সমাজে গণিত ছাড়া তো দর্শনও পড়া যাবে না। গণিত ছাড়া বিজ্ঞান কাভার করা যায় না, ব্যবসা কাভার করা যায় না। সুতরাং অন্তত এই লেভেলের গণিত একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল লেভেলে শিখতে হবে। আর যারা বিজ্ঞান পড়ছে, তারা সাহিত্য পড়বে না? না পড়লে তারা কীভাবে সমাজ-সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাবে, সেটাও তো তাদের পড়তে হবে। আমি বিজ্ঞানে পড়ব, গণিতে ভালো, কিন্তু আর্টস পড়ব না, ভাষা পড়ব না, বাংলা-ইংরেজিতে দক্ষতা থাকবে না, তাহলে তো এটা হাফ-হেডেড এডুকেশন হলো। আমরা তো চাই সবকিছু থাকুক।’

‘আমার মনে হয় এসএসসি লেভেলে যে গণিত আছে, যে সাহিত্য আছে, সেটা যদি যথাযথভাবে পড়ে, তাহলে শিক্ষার্থীদের পছন্দ করতে অসুবিধা নেই। ভবিষ্যতে তো তারা নিজেদের পছন্দ মতো নিতে পারছে। এতে কোনো অসুবিধা হবে না’, যোগ করেন অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী।

আরও পড়ুন:

মাধ্যমিকে বিভাগ তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার: শিক্ষামন্ত্রী

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

6m ago