‘ফুটবল ছাড়া জীবনটাকে ভাবতে পারি না’

সম্ভবত, বাদলের জন্য ফুটবলবিহীন জীবন একাকী জীবন কাটানোর সমতুল্য ছিল।
badal roy
ছবি: খন্দকার তারেক

‘ফুটবল ছাড়া জীবনটাকে কীভাবে ভাবতে হয় তা জানিও না। আর ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন কিছু নিয়ে ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভবও।’

কথাগুলো সাবেক তারকা ফুটবলার বাদল রায়ের। ২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল তার; সিঙ্গাপুরে জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রায়শই ওই বাক্যগুলো উচ্চারণ করতেন তিনি।

সেই থেকে দেশের ফুটবলের সঙ্গে কমবেশি জড়িত ছিলেন বাদল। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি; গত বছর ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পর প্রিয় ক্লাব মোহামেডানকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাজ করে যাচ্ছিলেন। অথচ শরীরের বাম পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে হাঁটার সময় অন্য কারও সহায়তা নিতে হতো তাকে।

১৯৮৯ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার পরও নিজের ফুটবল সত্তা থেকে এক মুহূর্তের জন্য দূরে ছিলেন না বাদল। সেই তিনিই গতকাল (রবিবার) বিদায় নিয়েছেন তার ফুটবলের দুনিয়া থেকে।

গত ৩ অক্টোবরের বাফুফে নির্বাচনের পর মাত্র ৫০ দিনের জন্য ফুটবল থেকে দূরে ছিলেন বাদল। ওই নির্বাচনে তাকে চাপ প্রয়োগ করার অভিযোগ উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত সভাপতি পদে নির্বাচনে অংশ নিলেও আরেক সাবেক তারকা ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিনের কাছে হেরে যান তিনি।

বাফুফে নির্বাচনে পরাজয়ের পর বাদল এই প্রতিবেদকের কাছে বলেছিলেন, ‘আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে যে, আমি এখন ক্লাবের (মোহামেডান) কথা চিন্তা করতে পারব। দেখা যাক, গৌরবের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে পারি কিনা। যদি পারি, তাহলে ফেডারেশন যা করবে তার চেয়ে দেশের ফুটবলের জন্য মঙ্গলকর কিছু হবে।’

সম্ভবত, বাদলের জন্য ফুটবলবিহীন জীবন একাকী জীবন কাটানোর সমতুল্য ছিল। তিনি শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত ৫ নভেম্বর আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেসময় তার স্ত্রী মাধুরী রায় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘তার সমস্যা হলো, ফুটবল তার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গেঁথে আছে। ফুটবল ছাড়া সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা তার পক্ষে কঠিন। সত্যি বলতে, ফুটবল ফেডারেশনে সে নেই, এই বিষয়টা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।’

মাধুরী তখন আরও বলেছিলেন, চলতি মাসের শুরুর দিকে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর বাদল বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার হাতে খুব বেশি সময় নেই। পরবর্তীতে তার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

বাদলকে উদ্ধৃত করে মাধুরী বলেছিলেন, ‘যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমাকে যেন বাফুফেতে নেওয়া না হয়। বরং আমাকে শহিদ মিনার কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিও।’

বাদল ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। ১৯৯৯ সালে নেপালে এসএ গেমসে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছিল, তার পেছনে মূল কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। লাল-সবুজের খেলোয়াড়দের প্রেরণা যোগাতে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুতে উড়ে গিয়েছিলেন তিনি।

সবশেষ তিন দফায়, ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, জাতীয় দলের উন্নয়নে এবং দেশের সর্বোচ্চ ফুটবল সংস্থার হয়ে কাজ করেন বাদল। তখন বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি।

বাদলের মৃত্যুর পর সাবেক জাতীয় ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন, ‘ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা প্রমাণিত ও নিঃশর্ত। ফুটবলের জন্য তিনি নিজের পরিবারকেও বঞ্চিত করেছেন। বাফুফে নির্বাচনের চার-পাঁচ দিন আগে তিনি আমাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, এত চাপ তিনি সহ্য করতে পারছেন না। যদিও তিনি অসুস্থ ছিলেন, যদি তিনি বাফুফে নির্বাচনে অংশ না নিতেন, তাহলে আরও কিছুটা সময় বেঁচে থাকতেন।’

বাদলের স্মৃতিচারণায় টিপু যোগ করেন, ‘আমি তাকে প্রথমবার দেখেছিলাম ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে। তখন তিনি শের-ই-বাংলা জাতীয় ফুটবল লিগে কুমিল্লার হয়ে খেলতেন। আগা খান গোল্ড কাপের আগে ১৯৭৭ সালে তিনি মোহামেডানে ট্রায়াল দিতে এসেছিলেন এবং তাকে দলে নেওয়া হয়েছিল।’

তিনি আরও জানান, ‘সেই থেকে বাদল ছিলেন মোহামেডানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আমার লেফট উইং পজিশনে খেলতেন এবং ১৯৭৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। বাদলই (দেশের) একমাত্র খেলোয়াড় যিনি সারাজীবন একটি ক্লাবেই খেলেছেন এবং ঢাকার অন্য ক্লাবগুলো থেকে ভালো প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও কখনো মোহামেডান ছাড়েননি।’

বাদল তাই কেবল একজন নিবেদিতপ্রাণ ফুটবলার কিংবা সংগঠকেরই জ্বলন্ত উদাহরণ নন, বরং তিনি এমন একজন, যিনি ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসাকে বাকিদের জন্য অনুসরণীয় হিসেবে রেখে গেছেন।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago