বিশ্ববিদ্যালয় জীবন স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন
জীবনের সেরা সময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন! শুনতে শুনতেই আমরা বেড়ে উঠি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে বুঝতে পারি আমরা যা প্রত্যাশা করে বড় হয়েছি, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। আমরা আসলে যা প্রত্যাশা করি এবং তা পূরণ না হওয়ার কারণ কী?
একটি ক্লাস প্রজেক্ট থেকে শুরু হওয়া অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রজেক্টে উঠে এসেছে যে, ক্যাম্পাসের জীবনযাত্রার মান এবং অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখে শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট কি না সে বিষয়ে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত হয়। এই একত্র হওয়া কারও জন্য বন্ধুত্ব বাড়ানোর সুযোগ বলে মনে হলেও অনেকের কাছে এই অভিজ্ঞতা মধুর নাও হতে পারে। নতুন স্বাধীনতা, ক্লাব কার্যক্রমে অংশ নেওয়া বা ক্লাসের পরে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো অনেক শিক্ষার্থীর কাছে প্রত্যাশিত বিষয়। তবে, অন্তর্মুখী এবং মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকে এসব নিয়ে প্রায়শই উদ্বেগের মধ্যে থাকে। কারণ নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া তাদের কাছে খুব সহজ হয় না। শিক্ষার উচ্চ ব্যয়, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, অনেককে দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখে। যারা অনেক আশা নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাদের খরচ নিয়ে চিন্তা কম থাকে।
অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনার বিষয় নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়ে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ও দারুণ কিছু শিখতে চায়। ভাগ্যবান শিক্ষার্থীরা এমন সমমনা শিক্ষার্থী বা সিনিয়রদের খুঁজে পায়। কেউ কেউ কোর্সের পাশাপাশি বিতর্ক এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। আর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে সেই পুরনো ঐতিহ্যগত মুখস্থ বিদ্যার মধ্যে মুখ গুজে থাকতে হয়, যেগুলো দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বের প্রেক্ষাপটে আপডেটও করা হয় না। তাদের ভেতরে প্রশ্ন জাগতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা এমন কী শিখছে? তাদের অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতা কি বাস্তব জীবনে কাজে আসবে, বিশেষ করে যখন তারা চাকরি খুঁজতে বা তাদের ক্যারিয়ার গড়তে যাবে? তারা একটি সমৃদ্ধ শিক্ষার প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা পায় না।
কিছু শিক্ষার্থী এমন ক্যাম্পাস চায় যেখানে উন্মুক্ত মাঠ এবং উদ্যান আছে। আর কিছু শিক্ষার্থী চায় অত্যাধুনিক ল্যাব এবং বিস্তৃত গ্রন্থাগারের সুবিধা। এখনো অনেকে আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে ব্যতিক্রম কিছু করার বড় স্বপ্ন নিয়ে এবং সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করতে। তাদের প্রত্যাশা থাকে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তা পারে না।
যারা গ্রাজুয়েশনের পাঠ নেওয়ার সময় বা তার পরেও নিজেদের সম্পূর্ণ বলে মনে করতে পারছে না, তাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী করবে? এই প্রশ্নের সমাধান অনেকগুলো স্তরে করা উচিত। শিক্ষা পরিকল্পনাকারী এবং নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, অনুষদ সদস্য এবং এমনকি শিক্ষার্থী পর্যায়েও।
নবীনবরণের দিনই নবাগতদের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। যাতে করে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে যে তারা কী করতে চলেছে এবং নিজেদের ভেতরে কী ধরনের প্রত্যাশা তৈরি করবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি এবং পরস্পর সহজ হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু মজাদার সেশনের ব্যবস্থা করতে পারে।
আমরা বাস্তবের মুখোমুখি হতে চাই বা না চাই, বাস্তবতা হলো শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক অভিজ্ঞতা অন্বেষণ এবং নিজেকে খুঁজে পেতে পাঠ্যক্রমের বাইরের কার্যক্রমে খুব কমই সময় দেয়। এই কার্যক্রমগুলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সমন্বয় করা একটু কঠিন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ভূমিকা নিতে পারে। বিভিন্ন পটভূমি, অভিজ্ঞতা এবং আগ্রহের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করতে পারে। সেমিনার-বক্তা, শিল্পী, সমাজকর্মী, বিভিন্ন পেশাদার, এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারে এবং নিজেদের আলোকিত করতে পারে।
শুধুমাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যবসায়ী হলেই কেউ সফলতা পেল, এই ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, এইগুলো ছাড়াও আরও অনেকভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকাশ করতে পারে। গবেষক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগীতজ্ঞ ও লেখকরা বহু প্রত্যাশিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবন’ থেকেই তাদের শুরুটা করতে পারে। সঠিক প্ল্যাটফর্ম এবং সহযোগিতা দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ক্লাব গঠন করতে, অংশ নিতে, কার্যক্রম করতে এবং নিজেদের প্রতিভা তুলে ধরতে পারে। এ ছাড়াও, এর মাধ্যমে অনুষদ সদস্যরাও ক্লাসের স্লাইড শো আর লেকচারের বাইরে শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু শেখাতে পারেন।
একটি সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনে বিশাল ভূমিকা রাখার সক্ষমতা রয়েছে। তারা রোবট নয় যে চাহিদা মতো উৎপাদনশীল হয়ে উঠবে। মানুষ হিসেবে তাদের উৎপাদনশীলতা আনন্দ, প্রেরণা ও উপভোগের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকবেই। অবশ্যই শিক্ষার্থী ও কর্তৃপক্ষকে যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে একটি সার্থক ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করতে কাজ করতে হবে। এভাবেই তারা একসঙ্গে একটি উন্নত জাতি গঠনের সহ-স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারবে।
সিফাত জেরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। ড. আন্দালিব পেনসিলভেনিয়া রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ইমেরিটাস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অনুষদের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এই নিবন্ধটি তৈরি করেন এবং অপ-এডের জন্য উপস্থাপন করেন ড. আন্দালিব। অপ-এডগুলো লেখা হয়েছে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ওপর আলোকপাতের মাধ্যমে একে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে। ‘অ্যাকাডেমিক এক্সপেরিয়েন্স প্রকল্প’তে অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ড. আন্দালিবের সঙ্গে [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments