মোহামেডানের বাদল রায়
পাওলো মালদিনির নাম মনে করলেই আপনি নিশ্চিত এসি মিলানের নামটাও অবচেতন মনে তুলে আনবেন। তেমনি রায়ান গিগস কিংবা পল স্কোলসের কথা মনে করলে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নাম। ফ্রান্সিস্কো টট্টির ক্ষেত্রে এএস রোমা। হ্যাভিয়ার জেনেত্তির ইন্টার মিলান, কার্লোস পুয়েলের বার্সেলোনা, স্টিফেন জেরার্ডের লিভারপুল। এমন আরও অনেক খেলোয়াড়ই আছেন যাদের নামের পাশে ক্লাবের নামটাও ট্যাগ হিসেবে লেগে আছে।
বাংলাদেশেও এমন একজন আছেন যার নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটি ক্লাবের নামও উচ্চারিত হয়। ঢাকা লিগে পা রাখার পর ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত এমনকি খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কর্মকর্তা হিসেবেও ছিলেন সেই ক্লাবের। তিনি আর কেউ নন বাদল রায়। মোহামেডানের বাদল রায়। দেশের ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তি এক খেলোয়াড়।
অথচ বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে ঘরোয়া লিগের ফুটবলাররা তো বটেই জাতীয় দলের ফুটবলাররাও কে কবে কখন কোন দলে খেলেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না নিজেরাও। সমর্থকরা তো অনেক দূরে।
হালের লিওনেল মেসির কথাই ধরুন। এখন পর্যন্ত বার্সেলোনাতেই আছেন। একটি ক্লাবে শুরুর পর এখনও আছেন সেই দলেই। তার নাম মনে করলেই আসে এফসি বার্সেলোনার নাম। যদিও গুঞ্জন রয়েছে ক্লাব ছাড়ার। আর আগামী মৌসুমে কাতালান ক্লাবটি ছাড়লে চড়া মূল্য দিতে হবে বার্সেলোনাকে। লোয়ালটি বোনাস হিসেবেই দিতে হবে ৩৩ মিলিয়ন ইউরো। বাদল রায় হয়তো এতো বিপুল অর্থ পাননি, কিন্তু পেয়েছেন অনন্য সম্মান।
কোনো এক সাক্ষাৎকারে এ কিংবদন্তি নিজেই বলেছিলেন, 'আমি ১৫ বছর মোহামেডানে খেলেছি, কখনো টাকা নিয়ে দেনদরবার করিনি। অর্থটা কখনোই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল না। দেশের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক আমি হয়তো সবসময় পাইনি; কিন্তু সবসময় সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছি।'
১৯৭৭ সালে ঢাকার ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল বাদল রায়ের। স্বাভাবিকভাবেই মোহামেডানের জার্সি গায়ে। আগা খান গোল্ডকাপে দিয়ে শুরু। তবে ঢাকা লিগের প্রথম ম্যাচে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে খেলেই সবার নজর কাড়েন। চার গোলে জয় পায় মোহামেডান। যার দুটোই ছিল বাদল রায়ের। এরপর বাকি গল্প তো কেবলই ইতিহাস।
মোহামেডানে বাদল রায়ের সুযোগ পাওয়ার গল্পটাও দারুণ। কুমিল্লার ছেলে বাদল স্থানীয় একটি ক্লাবের হয়ে খেলতেন। পরে কুমিল্লা লিগের হয়ে খেলতে গিয়ে নজরে পড়ে যান মোহামেডানের কর্মকর্তাদের। লিগের শিরোপানির্ধারণী সে ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন মোহামেডান কর্মকর্তারা। তখন দেশ সেরা ক্লাব মোহামেডান। এরপর এগিয়ে গেছেন দুর্বার গতিতে।
অবশ্য একের পর এক ইনজুরির কারণে কিছুটা আগেভাগেই ফুটবল ছাড়তে হয়েছিল বাদল রায়কে। তবে পুরোটা সময় ছিলেন মোহামেডানের। এর মাঝে অন্য ক্লাবের অনেক প্রস্তাবই পেয়েছেন। ১৯৮২ সালে একবার সালাউদ্দিন, চুন্নু, আশীষদের সঙ্গে খেলার রোমাঞ্চে আবাহনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। যে দিন আবাহনীর সঙ্গে চূড়ান্ত কথা বলতে যাওয়ার কথা ছিল তার, আগের রাতে বুঝতে পারেন মোহামেডানের মায়া তিনি ছাড়তে পারবেন না। তাই লোভনীয় প্রস্তাবও ছেড়ে দেন তিনি। এরপর আর কখনোই এ ক্লাব ছাড়ার কথা দ্বিতীয়বার ভাবেননি।
'খেলা ছেড়েছি ৯০-এর মাঝামাঝি সময়ে। এরপর ১৯৯১-তে মোহামেডানের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিই। আমি আসলে খেলোয়াড়ি জীবনে এবং তা শেষ করার এত বছর পরও মোহামেডানের বাদল রায় হয়ে আছি। এ নিয়ে আমার গর্বের শেষ নেই।' – মোহামেডান তার জন্য কি ছিল তা বোঝাতে এমনটাই বলেছিলেন এ কিংবদন্তি।
Comments