রাজনৈতিক ‘শূন্যতা’ ও হেফাজতের ভাস্কর্য ইস্যু

ভাস্কর্য আর মূর্তির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনায় মুখর বাংলাদেশের একাধিক মন্ত্রী। ভাস্কর্য আর মূর্তি যে এক নয় সেই বিষয়টি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন তারা।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ।

ভাস্কর্য আর মূর্তির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনায় মুখর বাংলাদেশের একাধিক মন্ত্রী। ভাস্কর্য আর মূর্তি যে এক নয় সেই বিষয়টি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন তারা।

দেশে এত বড় বড় সমস্যা থাকতে ভাস্কর্য বা মূর্তি কেন এত বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ালো?

হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক থাকার পরও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কেন এমন অবস্থানে হেফাজতে ইসলামের নেতারা?

এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, একই বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বায়ো কেমেস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের সঙ্গে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তাদের সামনে তো কোনো ইস্যু নেই। তারা একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করে। দেশের মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা, চাকরির সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে তারা ইস্যু তৈরি করে না। তারা আসলে লায় পেয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে সমঝোতার যে পলিসি সরকার নিয়েছে, সেটা দিয়ে তারা শক্তি সঞ্চয় করেছে, আরও শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পার্লামেন্টেও নেই, রাজপথেও নেই। এই শূন্যতার সুযোগ তারা (হেফাজতে ইসলাম) নিতে চাচ্ছে। এই সুযোগটা নিয়ে তারা দাঁড়িয়ে যাবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ বা কষ্ট আছে সেটাও তারা ক্যাপিটালাইজ করতে চাচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি হতে চাচ্ছে। তাদের সমর্থন দেবে সব ধর্মীয় দলগুলো, জামায়েতে ইসলামও তাদের সমর্থন দেবে।’

ফ্রান্সের পণ্য বর্জনসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যু হেফাজতে ইসলাম তৈরি করেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো তাদের ইস্যু, জাতীয় ইস্যু না। এক সময় হয়তো তাদের একটি রাজনৈতিক পার্টিই দাঁড়িয়ে যাবে।’

সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য বা এয়ারপোর্ট চত্বর থেকে লালনের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মীয় দলগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে, তখন যাদের দাবিতে এই ভাস্কর্যগুলো সরানো হয়েছিল তারা ছিল একটি গ্রুপ। আর এখন যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছেন তারা আরেকটি গ্রুপ। তিনি বলেন, ‘এই গ্রুপ ভাবছে, আগের গ্রুপ তো যা সুযোগ নেওয়ার নিয়েছে। এখন আমরা আবার কিছু সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করি। এটাই তাদের স্ট্র্যাটেজি বলে আমার মনে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা জানে যে সরকার তাদের পপুলারিটি বাড়াচ্ছে। সেই জায়গাটিকে মার্ক করার চেষ্টা করবে এই দলটি। সরকারের কাছ থেকে সুযোগ নিয়ে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল করবে, নির্বাচন করবে, ক্ষমতার অংশ হবে। তাদের কিছু মারাত্মক মারাত্মক এজেন্ডা আছে। এখনই এদেরকে যদি মোকাবিলা না করা যায়, তাহলে সামনে কিন্তু অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।’

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘যদি ইসলামের মূল্যবোধের জায়গা থেকে চিন্তা করা হয়, তাহলে হেফাজতকে দুর্নীতি, হত্যা, গুম, সম্পদ লুটপাট, ধর্ষণ, এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদেরকে বলাৎকার করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখি না। তারা যদি সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতো, সমাজে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করত, তখন তাদের কথাকে সবাই আরও বেশি গুরুত্ব দিত। আপনি যেকোনো জিনিসের বিরোধিতা করতে পারেন, আপনার মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু, আপনি তো জোর করতে পারেন না। আপনি বলতে পারেন যে এটা ভাস্কর্য, এটা নিয়ে ইসলামের ব্যাখ্যা এই, আমরা এটার বিরোধিতা করছি। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, এই মতের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের আছে। এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কোনো বিষয়বস্তু না।’

হজের জন্য ছবি বাধ্যমূলক করা হলে ছবি তোলা নিয়েও বিরোধিতা হয়েছিল। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘সে সময় মুসলিম পরিবার আইনে এমেন্ডমেন্ট করা হয়। এই বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বাধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কিন্তু এটাকে মেনে নেওয়া হয়েছে।’

সমাজের একটি বড় অংশের মানুষ তাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কেউ দুর্নীতি করতে পারবে না, কেউ অসৎভাবে টাকা উপার্জন করতে পারবে না, কেউ গুম করতে পারবে না, কেউ ধর্ষণ করতে পারবে না, কেউ দেশ বিরোধী কাজ করতে পারবে না- এমন সব বিষয় নিয়ে তারা যদি কথা বলত তাহলে তাদের ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্যটাও আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে মানুষ শুনত। এখনকার পরিস্থিতিতে তাদের অন্ধ অনুসারী ছাড়া আর কেউ এসব কথায় খুব বেশি অনুপ্রাণিত হবে বলে আমার মনে হয় না।’

‘যেকোনো বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার অধিকার সবারই রয়েছে বলে আমি মনে করি। তবে সেটা চাপিয়ে দেওয়া, জবরদস্তিমূলক হওয়া বা হুমকিমূলক হতে পারবে না। বক্তব্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, সেই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্য নাগরিকরা একমত নাও হতে পারে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কোনো ইসলামিক রাষ্ট্র না। তারা যদি ইসলামিক আইন অনুযায়ী, তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করতে চায় তাহলে আগে তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে হবে।’

সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের একটি অপ্রকাশিত অ্যালায়েন্স আছে। এই অ্যালায়েন্সটা এমন যে হেফাজতে ইসলাম দু-একটি বিষয় ছাড়া সরকারকে অন্ধভাবে সমর্থন দেবে। হেফাজতের বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী তো বলেই দিয়েছেন যে বর্তমান সরকার ১০০ বছর বা ৫০০ বছর দেশ শাসন করলেও হেফাজতের আপত্তি নেই। আর এর বিনিময়ে সরকার হেফাজতের বহু অন্যায় দাবি মেনে নেবে। লালনের ভাস্কর্য সরানো হয়েছে, গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তাদের দাবি অনুযায়ী। কিন্তু, সংঘাতের জায়গা তৈরি হয়েছে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে তারা কথা বলেছে। এখন আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সেক্যুলার হয়ে গেয়ে, অত্যন্ত প্রগতিশীল হয়ে গেছে, এমন একটি স্ট্যান্ট নিয়েছে। এটার কোনো আদর্শিক ভিত্তি নেই। আওয়ামী লীগের এই অবস্থানে পেছনে কোনো আদর্শিক ভিত্তি নেই। শুরুতেই ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়ে হেফাজত যখন বলেছে, তখন কি আওয়ামী লীগ বিরোধিতা করেছে? করেনি। এখন বিরোধিতা করছে। এটা কোনো আদর্শিক ভিত্তির কারণে নয়। এটা মূলত একটি ইভেন্ট বেইজড দ্বন্দ্ব। আর কোনো বিষয়ে তাদের মধ্যে সমস্যা নেই। আমি বিশ্বাস করি অন্য সব বিষয়ে তাদের মধ্যে একটি অঘোষিত অ্যালায়েন্স আছে।’

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, ‘দেশে হাজারো সমস্যা। রাজনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যার ভিড়ে ভাস্কর্যকে ইস্যু বানানোর কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বোধগম্য না। এত সমস্যা ছাপিয়ে ভাস্কর্য বা মূর্তি, যেটাই বলেন, একটি প্রধান আলোচনা বা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিষয় কেন হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। প্রতিটি দেশের, প্রতিটি জাতির নিজস্ব কালচার আছে, নিজস্ব ঐতিহ্য আছে। এ দেশ গঠনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের যুগের পর যুগ স্মরণ রাখা প্রয়োজন। তার জন্য যা করা দরকার সেটা যেমন করতে হয়, সেই সঙ্গে দেশের মানুষের মন-মানসিকতা এবং দেশের কালচালার হেরিটেজের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখতে হয়। আমাদের শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ নিয়ে তো এধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।’

হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এবং এয়ারপোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানো হলেও এখন ভাস্কর্য বিষয়ে সরকারের অবস্থান ভিন্ন হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হয়তো সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে পরিবর্তন হতে পারে। হেফাজতের উত্থানের পর অনেক ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের সঙ্গে তাদের নৈকট্য বেড়েছে, সেই নৈকট্যের কারণে তাদের অনেক ধরনের দাবি সরকার পূরণ করেছে। তখন সব দাবি মেনে নিলেও এখন তার বিরোধিতা করায় তো বড় ধরণের প্রশ্ন তুলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে যদি আপনি রাজনৈতিক দল হিসেবে চিন্তা করেন, তারা স্বাধীনতার স্থপতির বিষয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়ে সবসময়ই অগ্রাধিকার দেয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটা হয়তো ঠিক যে, অন্য কোনো বিষয় হলে তারা যতটা প্রতিক্রিয়া দিত এই বিষয়ে হয়তো তারা একটু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।’

Comments

The Daily Star  | English

Fashion brands face criticism for failure to protect labour rights in Bangladesh

Fashion brands, including H&M and Zara, are facing criticism over their lack of action to protect workers' basic rights in Bangladesh, according to Clean Clothes Campaign (CCC)..One year after a violent crackdown by state actors and employers against Bangladeshi garment workers protesting

7m ago