কালজয়ী গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই পৈতৃক ভিটায়
মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে… গানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে তুলে ধরে, আবার কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই… মান্না দে’র সেই স্মৃতি জাগানিয়া গানটি প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে আজও গেঁথে আছে। কিন্তু, কালজয়ী এসব গানের রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের স্মৃতি চিহ্নগুলো অবশিষ্ট নেই।
উপমহাদেশের কালজয়ী বাংলা গানের গীতিকার ও সুরকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
গোপালনগর গ্রামের পূর্বপুরুষের বাড়িতে বেড়ে ওঠা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ওই গ্রামের মাটিতে শৈশব ও কৈশোর কাটালেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ার জন্য কলকাতায় পাড়ি দেন। এক সময় নিয়মিত গ্রামের বাড়িতে আসা-যাওয়া থাকলেও, ৬০ এর দশকে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের পরিবারের সবাই ভারতে পাড়ি জমায়, তারপর থেকে আর গ্রামে আসা হয়নি কালজয়ী এ গীতিকারের। গ্রামের বিশাল এস্টেটের সব এখনো পড়ে আছে, শুধু নেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের স্মৃতি চিহ্ন।
সরেজমিনে দেখা যায়, গৌরীপ্রসন্নের পৈতৃক বাড়িটি এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্মৃতিচিহ্ন বলতে আছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি তালগাছ আর একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর। মূল বাড়ির ধ্বংসাবশেষে এখন জঙ্গল আর ময়লার স্তূপ।
ফরিদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪-৭৫ সালে গোপালনগর মৌজায় মজুমদার এস্টেটের ৩৩ একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে সেখানে ৫০ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে।
গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের প্রতিবেশী বাবলু লাহিড়ী জানান, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসে শেষবারের মতো পৈতৃক ভিটায় আসেন তিনি। ভারতে চলে যাওয়ার সময় গোপালনগরে তাদের বিশাল উঠোনসহ তিনতলা বাড়ি ছিল। ১৯৮০’র দশকে কিছু কিছু স্মৃতিচিহ্ন থাকলেও সেগুলোর কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই।
বাবলু লাহিড়ী বলেন, ‘গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের এলাকার মানুষ হিসেবে গর্ব অনুভব করলেও এটা দুর্ভাগ্যজনক যে তার কোনো স্মৃতিই আমরা ধরে রাখতে পারিনি। গোপালনগরে উপজেলা হাসপাতাল তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে তার কোনো স্মৃতিফলক পর্যন্ত নেই।’
‘হাসপাতালের পেছনেও অনেক জায়গা পড়ে আছে। সরকার চাইলে সেখানে স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠাগার ও সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে পারে,’ বলেনি তিনি।
আমরা ভুলে গেলেও ভুলতে পারেননি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সেজন্যই বাংলাদেশের মানুষ যখন মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তখন কাছে না থেকেও বাংলাদেশের মানুষের পাশে ছিলেন গৌরি প্রসন্ন মজুমদার। ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ কিংবা ‘মাগো ভাবনা কেন আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কালজয়ী এ গান দুটি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে।’
পাবনার সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাংবাদিক আব্দুল মতীন খান বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য গানের রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আমাদের পাবনার সন্তান। বিষয়টি যেমন আমাদের গর্বিত করে, ঠিক একইভাবে এই কালজয়ী গীতিকবির গর্বিত অবদান তুলে ধরতে পাবনায় কোনো উদ্যোগ না থাকাটা লজ্জাজনক।’
তিনি যে আমাদের পাবনার সন্তান তাও অনেকের অজানা। মুজিববর্ষেই তার স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট কালজয়ী গীতিকার দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের চল্লিশ বছর গানের জগতে কথা সাজানো আর মিল জুড়িয়ে গৌরীপ্রসন্ন নিজ গানেই আকুতি রেখেছেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখো না’। তবে, বাঙালি তাকে ভোলেনি, স্মৃতির মণিকোঠায় আপন কর্মে স্থায়ী হয়ে আছেন।
পাবনার ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান মাজেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের স্মৃতি ধরে রাখতে ফরিদপুর পৌরসভা একটি রাস্তা তার নামে নামকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। একইসঙ্গে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি লাইব্রেরি স্থাপন করা হবে।’
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও কেন তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এ গীতিকারের স্মৃতিকে আমরা ধরে রাখার জন্য কোন উদ্যোগ নিতে পারিনি।’
Comments