আজকের দিনে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল পটুয়াখালী
আজ ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে দীর্ঘ আট মাস অবরুদ্ধ থাকার পর ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। মিত্রবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই প্রতিরোধ আর সম্মুখ যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় শহরের চারিদিকে।
টের পেয়ে আগের রাতে নিষ্প্রদীপ কারফিউ জারি করে লঞ্চযোগে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। পরদিন অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করলে রাজাকার ও আলবদররা অস্ত্র-সস্ত্র ফেলে পালাতে থাকে। বিনা বাধায় মুক্তিয়োদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পটুয়াখালী জেলা শহরের। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আনুগত্য প্রকাশ করে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এইদিনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।
আজ দিবসটি পালন উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পটুয়াখালী ইয়ুথ ফোরাম সকাল ১০টায় শহীদ আলাউদ্দিন শিশু পার্কে পতাকা উত্তোলন ও পতাকা মিছিলের আয়োজন করেছে। এ ছাড়া, খেলাঘর, দখিনা খেলাঘর আসর, সুন্দরম সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র আলোর মিছিল, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন, আলোচনা, সঙ্গীত ও কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছে।
২৬ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত একমাস পটুয়াখালী জেলা ছিল মুক্তাঞ্চল। সেসময় সংগ্রাম পরিষদ বর্তমান সরকারি মহিলা কলেজে জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করে তিন শ মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমএ আউয়াল এ কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি পুলিশ লাইনস থেকে রাইফেল ও গুলি তুলে দেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। পরে এজন্য পাকহানাদাররা তাকে গুলিবিদ্ধ করলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল, সকাল সাড়ে ১০টা। পাক-হানাদারদের জঙ্গীবিমান ছুঁটে আসে পটুয়াখালীর আকাশে। শুরু হয় বিমান হামলা। চলে শেলিং আর বেপরোয়া গোলাবর্ষণ। একনাগারে কয়েক ঘণ্টা বোমা হামলা চালিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে কালিকাপুর মাদবরবাড়ি এলাকায় অবতরণ করে পাকিস্তানী ছত্রীসেনা। ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর, চালায় নির্বিচারে গণহত্যা।
মারনাস্ত্রের ভয়ংকর শব্দ, আক্রান্ত মানুষের আর্তনাদ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সবমিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক নরকীয় পরিস্থিতি। অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয় শহরের বাণিজ্যিক পুরান বাজার এলাকা। যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে মুক্তিকামী জনতার অগণিত মরদেহ। ওই দিনে প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণা, পাকহানাদারদের গণহত্যায় তিন শতাধিক মানুষ শহীদ হয়। এ ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে ও জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় দেড় হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষকে। মাদবরবাড়ি, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের অদূরে আনসারদের ভবন ও পুরাতন জেলখানার অভ্যন্তরের বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার নির্মম স্বাক্ষ্য বহন করে আছে আজও।
পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে পানপট্টি গ্রাম। নয় নম্বর সেক্টর হেড কোয়াটারের নির্দেশে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি মুক্তিযোদ্ধা দলকে কেএম নুরুলল হুদা (বর্তমান সিইসি কেএম নুরুল হুদা) ও প্রয়াত হাবিবুর রহমান শওকতের নেতৃত্বে পাঠানো হয় পটুয়াখালী এলাকায়। তারা ক্যাম্প স্থাপন করেন পানপট্টি সাইক্লোন সেল্টারে। ১৮ নভেম্বর সকাল ৬টার দিকে আকস্মিকভাবে পাক বাহিনীর মেজর ইয়ামিনের নেতৃত্বে পাক-হানাদারদের একটি বাহিনী আক্রমণ করে সেখানে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। দুই পক্ষের গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমগ্র এলাকা।
মুক্তিযোদ্ধাদের তিনদিক থেকে আক্রমণে পাকবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে ও তাদের কয়েকজন হতাহত হয়। বিকেল ৪টার দিকে পিছু হটতে শুরু করে ইয়ামিন বাহিনী। এদিকে, ওই এলাকার জনতা মুক্তিযোদ্ধদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। তারা ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে এলাকা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা বেগতিক বুঝে হানাদাররা তাদের সহযোদ্ধাদের মরদেহ ফেলে রেখেই পালিয়ে যায়। বিজয় অর্জিত হয় পানপট্টির যুদ্ধে। জেলার প্রথম মুক্তাঞ্চল পানপট্টিতে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তোলন করে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত লাল-সবুজের পতাকা।
Comments