আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস

দুদকের তর্জন গর্জন

ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ যারা অর্জন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে গর্জন শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ যারা অর্জন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে গর্জন শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এই অবৈধ ব্যবসার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে গত ১ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখব। বড় বা ছোট- কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

গত বছর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোতে অভিযান চালানো শুরু করলে দুদককে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। এর মধ্যে ছিল অ্যাকাউন্ট জব্দ করা এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। দুদকের এমন ব্যবস্থা গ্রহণ অনেকের মধ্যেই আশা জাগিয়েছিল।

তবে সেই তদন্ত গতি হারিয়েছে।

মার্চের শুরুর দিকে দেশে কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার পর থেকে ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত অনিয়ম বেড়ে গেলে দুদক তার দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উপপরিচালক বলেন, ‘যখনই কোনো নতুন সমস্যা সামনে আসে, আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয় সেখানে মনোনিবেশ করতে। দিনের শেষে আমরা মামলাগুলো নিয়ে খুব বেশি দূর এগোতে পারি না। যার কারণ, অনুসন্ধান এবং তদন্ত আমাদের ডেস্কেই স্তূপ হয়ে থাকে।’

‘দুদকের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কখনই পূরণ হয় না,’ যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

এমনই হতাশার মধ্য দিয়ে আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘শুদ্ধাচারেই পুনরুদ্ধার’।

ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান

ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন রাঘব বোয়ালের নাম প্রকাশিত হয়েছিল। তদন্ত শুরু করতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় দুদক। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে এবং বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিলেন সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও শামসুল হক চৌধুরী।

পরবর্তীতে আফজাল হোসেন, মাহফুজুর রহমান মিতা, পঙ্কজ নাথ, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহি বি চৌধুরী, নজরুল ইসলাম বাবু, আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কাজী শহিদুল ইসলাম ওরফে কাজী পাপুল ও সেলিনা ইসলামসহ অন্যান্য সংসদ সদস্যের নাম উঠে আসে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে।

তাদের মধ্যে কাজী পাপুল ও সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রায় ১৪৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা পাচারের মামলা করেছে দুদক।

সাবেক সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হক, কামরুল আশরাফ খান পটন, আবদুল আউয়াল, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও শামসুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছে দুদক।

তদন্ত শেষে শামসুল হক ও আবদুল আউয়ালের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, আবদুল মোমিন তালুকদার ও জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।

বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে দুদকের একজন পরিচালক বলেন তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন এবং ‘নথি পরীক্ষা করে দেখছেন’।

এছাড়াও ক্যাসিনো অভিযানের পর ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের ২২টি মামলা করেছে দুদক।

এখন পর্যন্ত চারটি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এই চারটি মামলা করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, সম্রাটের সহযোগী জাকির হোসেন এবং সেলিম প্রধানের নামে।

স্বাস্থ্য খাতে অনিয়মের তদন্তেও তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

কোভিড-১৯ দেশে আঘাত হানার পর মহামারি মোকাবিলায় সরকার মাস্ক, পিপিই এবং অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়।

সংকট কাজে লাগিয়ে বাড়তি টাকা অর্জনের চেষ্টায় সরবরাহকৃত চালানে এক-চতুর্থাংশ নিম্নমানের মাস্ক দেওয়া হয়। তবে তা সামনে আসে কয়েকজন চিকিৎসকের প্রতিবাদের কারণে।

গত ১৮ জুন পিপিই, মাস্ক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয় ও বিতরণে অনিয়ম তদন্তের জন্য একজন পরিচালকের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দুদক।

কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিত্সায় সম্পৃক্ত চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং এজন্য বরাদ্দও দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, কিছু শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা এই বরাদ্দের অপব্যবহার করেছেন।

এ বিষয়ে দুদক কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কয়েকটি মামলা করা ছাড়া আর তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

জেএমআই হসপিটাল রিকুইসিট এমএফজি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক এবং ছয় চিকিৎসকের নামে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের একটি মামলা করা হয়।

রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ শাহেদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে দুটি মামলা করেছে দুদক।

সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের এক জরিপে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতারা বলেছেন, দুর্নীতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন ভালো কাজ করছে।

‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-এশিয়া ২০২০’ শিরোনামের এই জরিপ পরিচালিত হয়েছিল এক হাজার মানুষের ওপর।

‘কিছু অগ্রগতি’

দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, মহামারির কারণে তদন্তের গতি কমে গেছে।

তদন্তে দেরির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের অসঙ্গতিগুলো অনুসন্ধান করতে চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। ‘যেহেতু চিকিৎসকরা ফ্রন্টলাইনে মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে ব্যস্ত, এই মুহূর্তে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে তা স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাঘাত ঘটাবে। সে বিষয়টি আমরা মাথায় নিয়েই কাজ করছি।’

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তিনি বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে।

গত রোববার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘শিগগির কিছু অগ্রগতি আপনারা দেখতে পাবেন।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ডা. ইফতেখারুজ্জামান নখ-দন্তহীন বাঘের সঙ্গে দুদককে তুলনা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘দুদক একটি বিভাজন রেখা টেনে নিয়েছে। ব্যক্তির পরিচয় এবং অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই বিভাজন রেখা তৈরি করা।’

ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসাসহ অনেক বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতাবানরা জড়িত না থাকলে সেগুলো চলতে পারত না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় রাজনৈতিক এলিটরা এটা জানত, প্রশাসন এটা জানত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও এটা জানত। এমন জায়গায় হাত দিলে দুদকের হাত পুড়ে যেতে পারে।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কিছু ছোট মাছ হয়তো সমস্যার মধ্যে পড়বে, কিন্তু রাঘব বোয়ালরা থেকে যাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

Comments

The Daily Star  | English
justice delayed due to fake cases

A curious tale of two cases

Two cases were filed over the killing of two men in the capital’s Jatrabari during the mass uprising that toppled the Awami League government.

14h ago