আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আজ সোমবার যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
Martyred Intellectuals Day
১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ছবি: পলাশ খান

মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আজ সোমবার যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

১৯৭১ সালের এ দিনে দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিল্পী, লেখক ও সাংবাদিকসহ অন্যান্য মেধাবী ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। পরে তাদের মরদেহ রাজধানীর রায়েরবাজার ও মিরপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঠান্ডা মাথায় এ গণহত্যা চালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ যাতে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. ডালিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ডা. ফজলে রাব্বি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সান্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দিন আহমেদ, এসএ মান্নান, এএনএম গোলাম মুস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক ও সেলিনা পারভিন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, যারা ১৯৭১ সালে বিজয়ের প্রাক্কালে হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।’

তিনি বলেন, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারই আহ্বানে গোটা জাতি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। হানাদার বাহিনী তাদের নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করার হীন উদ্দেশ্যে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনীর সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ বহু গুণীজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতি হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।

‘বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, উদার ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা জাতীয় অগ্রগতির সহায়ক। জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে বিপুল অবদান রাখেন। কিন্তু, জাতির দুর্ভাগ্য, বিজয়ের প্রাক্কালে হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রেখে যাওয়া আদর্শ ও পথকে অনুসরণ করে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই তাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে’, বলেন আবদুল হামিদ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ‘আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও তাদের দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।’

তিনি বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশের আপামর জনসাধারণকে সংগঠিত করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় জামায়াতসহ ধর্মাদ্ধ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামসবাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ,  অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করে। বাঙালি জাতির বিজয়ের প্রাক্কালে তারা দেশের শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, প্রকৌশলী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদসহ দেশের মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে।

‘স্বাধীনতা বিরোধীরা এই পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়। বাংলাদেশ যাতে আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেটাই ছিল এ হত্যাযজ্ঞের মূল লক্ষ্য।’

তিনি আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের এই পরাজিত শক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় এনেছে। বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। এই কুখ্যাত মানবতাবিরোধীদের যারা রক্ষার চেষ্টা করছে, তাদেরও একদিন বিচার হবে। এসব রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে। দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।’

আমি শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে, বলেন তিনি।

করোনা মহামারির কারণে এ বছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এ দুঃখজনক ঘটনার স্মরণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে ভার্চুয়ালি সেমিনার ও আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে।

Comments

The Daily Star  | English

Ban on plastic bags a boon for eco-friendly sacks

Availability of raw materials now a challenge

3h ago