ড. সিরাজুল হক খান: লাল রঙের কাদা মাখানো মাইক্রোবাস...

শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল হক খান। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া ছবি। ছবি সৌজন্য: মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ইপিবিআরটি (এখনকার বিআরটিসি) এর একটি লাল রঙের কাদা মাখানো মাইক্রোবাস এসে থামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারের ১৬ নম্বর দালানের সামনে।

সেই গাড়ি থেকে ৭-৮ জন মুখোশধারী লোক, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নেমে এসে বাসার কড়া নাড়েন। দরজা খুলে দেন ড. সিরাজুল হক খানের ছোট ভাই শামসুল হক খান। প্রথমে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় 'এ বাসায় সিরাজুল ইসলাম নামে কেউ আছেন?'

তিনি 'না' বলেন।

তারপর জিজ্ঞেস করা হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপক আছেন নাকি'।

প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে একসময় তিনি জানিয়ে দেন, সিরাজ সাহেব একই বিল্ডিং এর অন্য একটি ফ্ল্যাটে আছেন।

চোখে কালো কাপড় বেঁধে ড. সিরাজুল হক খানকে তুলে নিয়ে যায় রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

এর প্রায় তিন সপ্তাহ পর মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় তার কংকাল। পরনের কাপড় আর হাতঘড়ি দেখে সনাক্ত করেন তার ছেলে, আমার বড় চাচা ড. এনামুল হক খান।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হাতে অপহৃত এবং নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত ড. সিরাজুল হক খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্রের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক।

সারা জীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। তিনি স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের বেশ কিছু ইংরেজি, বাংলা এবং ইতিহাস বই লিখেছিলেন। কথিত আছে যে 'গণি মিয়া একজন কৃষক। তিনি তার মেয়ের বিবাহ দিতে গিয়ে অনেক টাকা কর্জ করিয়া ফেলিলেন' গল্পটিও ওনারই লেখা।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সিরাজুল হক খানের জন্ম ১৯২৪ সালের পহেলা জানুয়ারি, ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার সাতকুচিয়া নামে ছোট এক গ্রামে।

ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখা ও জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে অপরিসীম আগ্রহ। প্রায়শই ঘরে আলোর অভাবে তাকে রাস্তার দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যেত।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খুবই সুশৃঙ্খল ও নীতিবান। নিজের আদর্শগুলোকে ছেলে-মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন সবসময়। ভোরে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন এবং প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসতেন কাজে যাওয়ার আগে। বিকেলে মাগরিবের আজানের আগেই সবাইকে ঘরে ফিরতে হতো। বাসায় যারা কদাচিৎ দেরি করে ফিরতেন, তারা অনিবার্যভাবে তিরষ্কারের শিকার হতেন।

বাসায় একটি সাদা কালো টেলিভিশন ছিল, কিন্তু সন্তানদের অনুমতি ছিল না টিভি দেখার। শুধুমাত্র রাতের সংবাদ দেখার ব্যাপারটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। সেসময়টিতেই তিনি পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে সময় কাটাতেন।

ছেলে-মেয়েতে বিভেদ করতেন না তিনি। বাসায় যা রান্না হতো, তা সবার মাঝে সুষমবন্টনের নির্দেশ ছিল তার। একবার তার কনিষ্ঠ সন্তান ইলিশ মাছের ডিম একাই পুরোটা খেতে চাওয়ার আবদার করলে তিনি অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হন এবং শিশু সন্তানকে শাস্তি হিসেবে বারান্দায় পাঠিয়ে দেন। পরে অন্য সন্তানরা পরিস্থিতি সামলান।

ন্যায়নীতির ক্ষেত্রে তিনি কখনো আপোষ করেননি। ১৯৪৩ সালে বি.এ পাস করার পর সরকারের কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বিভাগে ইনস্পেক্টর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই চাকরিতে তার বেশিদিন থাকা হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে অবৈধ অর্থ লেনদেন এবং ঘুষ সংক্রান্ত প্রস্তাব পেয়ে অত্যন্ত রাগান্বিত এবং অপমানিত বোধ করেছিলেন তিনি।

পরে কাজে ইস্তফা দিয়ে ফুলগাজী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অফ টিচিং ডিগ্রি লাভ করেন এবং সে বছরেই ঢাকার আরমানিটোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় এবং সরকারি ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছিলেন কিছুদিন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এড ডিগ্রি নেন। সে বছরেই মার্কিন সরকারের একটি বৃত্তি পেয়ে কলোরাডো স্টেট কলেজে ডক্টর অব এডুকেশন প্রোগ্রামে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৮ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

উচ্চতর শিক্ষা শেষে দেশে এসে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করবেন এ ব্যাপারটিতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন ড. সিরাজুল হক খান। অনেকেই তাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে বিদেশে ভাল ক্যারিয়ার এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে। সেখানে থেকে গেলে তার নিজের এবং পরিবারের জন্য ভালো হবে। কিন্তু তিনি কারো কথা শোনেননি।

কলোরাডো থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতেন এবং পোস্টকার্ড পাঠাতেন। ১৯৬৭ সালে, দেশের ফেরার আগে তিনি লন্ডন, প্যারিস ও রোম ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন স্ত্রী ও বড় ছেলেকে (প্রয়াত ড. এনামুল হক খান, সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)।

জড়ানো হরফে লেখা সেই চিঠিতে ফুটে উঠেছে দেশে, পরিবারের কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষা এবং নতুন নতুন দেশ ভ্রমণের অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথা। স্ত্রীকে ভালবাসাময় চিঠি পাঠিয়েছেন প্যারিস থেকে।

ড. সিরাজুল হক খান ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ধারক ও বাহক এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল। শুরু থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং সেই চেতনা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পরিবারের মাঝেও।

সবাই যখন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছিল নিরাপত্তার জন্য তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের বাসভবনে থেকে বিভিন্নভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে গিয়েছেন। পঁচিশে মার্চের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুব কাছে থেকে দেখেছেন কিন্তু ভয় পাননি। সন্তানদের অভয় দিয়েছেন, বোঝানোর চেষ্টা করেছেন স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে।

স্পষ্টবাদিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কারণেই তার নাম চলে গিয়েছিল রাজাকার, আলবদর বাহিনীর হত্যা তালিকায়।

মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে পরে তার কংকাল দাফন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে।

এভাবেই অস্ত যায় একটি সম্ভাবনাময় জীবনের সূর্য এবং শুরু হয় ড. সিরাজুল হক খানের পরিবারের বাকি নয় সদস্যের জীবন সংগ্রাম এবং সুবিচার পাওয়ার সুদীর্ঘ অপেক্ষা।

(বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই দুজনের বিরুদ্ধে অন্যতম স্বাক্ষী ছিলেন, ড সিরাজুল হক খানের জেষ্ঠ পুত্র প্রয়াত ড এনামুল হক খান। কয়েক দশক ধরেই চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বৃটেনে এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।)

লেখক: ড. সিরাজুল হক খানের দ্বিতীয় পুত্র স্থপতি একরামুল হক খানের বড় ছেলে।

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

1h ago