বাবাকে দিয়ে ২ সন্তানের গুলিবিদ্ধ মরদেহ ট্রাকে তোলে পাকিস্তানি সেনারা

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে সারাদেশে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। হানাদারদের এই নির্মমতা থেকে বাদ পড়েনি কুমিল্লা অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার শতাধিক বুদ্ধিজীবী। হানাদাররা আইনজীবী যতীন্দ্র কুমার ভদ্রের দুই ছেলেকে বাড়ির সামনে হত্যা করে। তারপর যতীন্দ্র ভদ্রকে দিয়ে তার ছেলেদের গুলিবিদ্ধ দেহ সেনাবাহিনীর ট্রাকে ওঠায় পাকিস্তান বাহিনী।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক এ কে এম সামসুল হক খান (সিএসপি) এবং পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ (পিপিএম, পিএসপি)।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কে এম সামসুল হক খান (সিএসপি) তখন প্রশাসকের ভূমিকা পালন না করে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তার নির্দেশে কুমিল্লা সেনানিবাসে রেশন, বিদ্যুৎ, পানি ও যানবাহনের জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে গেলে পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ জেলা প্রশাসকের নির্দেশ ছাড়া স্টোরের চাবি হস্তান্তর করতে অপারগতা জানান। ফলে, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংস হামলায় কুমিল্লা পুলিশ লাইনে জেলা পুলিশের কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক, আরআই, পিআই, দারোগা, সহকারী দারোগা, সুবেদার ও হাবিলদারসহ ৩০ জন পুলিশ সদস্য নির্মমভাবে শহীদ হন।

একইদিনে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে গ্রেপ্তার করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা এবং পরে সেখানে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করে।

তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য শহীদ সামসুল হক খান ২০১০ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ভূষিত হন। তার নামে কুমিল্লা শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক বাংলোর ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ জেলা প্রশাসক সামসুল হক খান মঞ্চ।

ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, ২০১৪ সালে শহীদ মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদকে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। তার নামে কুমিল্লা শহরের একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে ছোট ছেলে দিলীপ কুমার দত্তসহ ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তিনি ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় কান্দিরপাড় কুমিল্লার নজরুল এভিনিউতে সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে আইনজীবী রুস্তম আলীর বাসার সম্মুখে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার অপরাধে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আইনজীবী যতীন্দ্র কুমার ভদ্রের বাড়িতে হানা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ‘অপারেশন কিল এন্ড বার্ন’-এর লেখক সাংবাদিক আবুল কাশেম হৃদয় জানান, সেদিন ক্যাপ্টেন নাসিম মালিকের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা আইনজীবী যতীন্দ্র ভদ্রের দুই ছেলেকে বাড়ির সামনে হত্যা করে। এরা ছিলেন- রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র কাজল কুমার ভদ্র এবং অন্যজন এসএসসি পরীক্ষার্থী রতন কুমার ভদ্র। যতীন্দ্র কুমার ভদ্রের মা ছিলেন ক্ষুদিরামের আদর্শে বিশ্বাসী ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় নারী বিপ্লবী।

অ্যাডভোকেট যতীন্দ্র ভদ্রের বাড়িতে হামলা করে আইন পুস্তিকার বিশাল সংগ্রহশালা ধ্বংস করা হয় এবং নারীদের নির্যাতন করা হয়। তখন যতীন্দ্র ভদ্রকে দিয়ে তার ছেলেদের গুলিবিদ্ধ দেহ সেনাবাহিনীর ট্রাকে ওঠায় পাকিস্তান বাহিনী। একই সময়ে যতীন্দ্র ভদ্রের বাড়ি থেকে তার জুনিয়র আইনজীবী প্রসন্ন কুমার ভৌমিক ও তারই কাকাতো ভাই প্রমোদ কুমার ভৌমিককে ধরে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। প্রসন্ন কুমার ভৌমিক ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে যতীন্দ্র ভদ্রের প্রিয়ভাজন ছিলেন। তিনি ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত ময়নামতি সেনানিবাসে জীবিত ছিলেন। 

শহীদ বুদ্ধিজীবী অ্যাডভোকেট যতীন্দ্র কুমার ভদ্রের প্রিয়ভাজন এই মহান বিজ্ঞ আইনজীবী প্রসন্ন কুমারসহ অন্যান্য সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।

কুমিল্লার ঐতিহ্য গবেষক আহসানুল কবির বলেন, ‘কুমিল্লায় শহীদ হওয়া সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে এখনই তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা উচিৎ।’

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

2h ago