মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায়

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সমাধিসৌধ ও একজন মধু মিয়া

লাখো বাঙালির অশ্রু আর রক্তে সিক্ত হয়েছিল যে মাটি, সেই মাটির বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠলেও সেই আনন্দের মধ্যেও মিশে ছিল চাপা কান্না, স্বজন হারানোর বেদনা। এমন শত বেদনার কথা আছে ইতিহাসের পাতায়, কখনোবা চাপা পড়ে গেছে কিছু অজানা অধ্যায়। আঞ্চলিক ইতিহাসে বিচ্ছিন্নভাবে এলেও জাতীয় ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি সুনামগঞ্জের ডলুরার ৪৯ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা। তবে তাদের জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নির্মাণ করেছেন সৌধ। যাকে গবেষকরা বলছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সমাধিসৌধ। যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দু-মুসলমান এক মাটিতে।
সুনামগঞ্জের ডলুরার সমাধিস্থল। ছবি: স্টার

লাখো বাঙালির অশ্রু আর রক্তে সিক্ত হয়েছিল যে মাটি, সেই মাটির বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠলেও সেই আনন্দের মধ্যেও মিশে ছিল চাপা কান্না, স্বজন হারানোর বেদনা। এমন শত বেদনার কথা আছে ইতিহাসের পাতায়, কখনোবা চাপা পড়ে গেছে কিছু অজানা অধ্যায়। আঞ্চলিক ইতিহাসে বিচ্ছিন্নভাবে এলেও জাতীয় ইতিহাসের পাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি সুনামগঞ্জের ডলুরার ৪৯ বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা। তবে তাদের জন্য স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নির্মাণ করেছেন সৌধ। যাকে গবেষকরা বলছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সমাধিসৌধ। যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দু-মুসলমান এক মাটিতে।

সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ের বালাট বাজার, এপারে চৌমুহনী বাজার ও পূর্বদিকে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ সীমান্ত হাটের মাঝামাঝি এলাকায় সীমান্ত পিলার ঘেঁষে পাহাড়ের পাদদেশে সুনামগঞ্জের ডলুরায় এই সমাধিক্ষেত্র। যেখানে ৪২ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪৩ জনকে দাফন ও ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাহ করার পর সমাধিস্থ করা হয়েছে।

সিলেটের লোক গবেষক সুমন কুমার দাস বলেন, সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘটনা ডলুরার ৪৯ মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসাম্প্রদায়িক চিন্তা এখানে দুর্লভভাবে ফুটে উঠছে। তা ছাড়া স্থানীয়রা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সেটি সংরক্ষণ করেছেন। যা আর অন্য কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই।

এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মধু মিয়ার নাম। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবনে যখন নেমে এসেছিল মৃত্যুর ভয়াল থাবা, পথে-ঘাটে পড়েছিল নিষ্প্রাণ দেহ। সেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থ করার তাগিদ অনুভব করেছিলেন আনসার কমান্ডার মধু মিয়া। নিজ গ্রাম ডলুরায় সরকারি এক একর ৬০ শতাংশ জমিতে সমাধিস্থ করেন শহীদদের।

আত্মনিবেদিত মধু মিয়ার লেখাপড়া পাঠশালা পর্যন্ত। একটা ডায়েরিতে লিখে রাখতেন শহীদদের নাম এবং কোথায় কোন যুদ্ধে তারা শহীদ হয়েছেন। অনেক সময় আবার আর কাউকে দিয়েও এ তথ্যগুলো লিখিয়ে রেখেছেন। আর এটিই আজ ইতিহাস। মধু মিয়ার ডাইরি থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় শহীদদের নাম-ঠিকানা। ১৯৭১ সালে মো. মন্তাজ মিয়া, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, মো. রহমত বখত, মো. জবান আলী, মো. তাহের আলী, মো. আব্দুল হক, মো. মুজিবুর রহমান, মো. নূরুল ইসলাম, মো. আব্দুল করিম, মো. সুরুজ মিয়া, মো. ওয়াহিদ আলী, মো. সাজু মিয়া, মোহাম্মদ ধনু মিয়া, মো. ফজলুল হক, মো. সামছুল ইসলাম, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. মরম আলী, মো. আব্দুর রহমান, মো. কেন্তু মিয়া, মো. মোস্তফা মিয়া, মো. সাত্তার মিয়া, মো. আজমান আলী, মো. সিরাজ মিয়া, মো. সমছু মিয়া, মো. তারা মিয়া, মো. আবেদ আলী, মো. আতর আলী, মো. লাল মিয়া, মো. চান্দু মিয়া, মো. সমুজ আলী, মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. দান মিয়া, মো. মন্নাফ মিয়া, মো. রহিম মিয়া, মো. আলী আহমদ, মো. ছিদ্দিক মিয়া, এমবি ছিদ্দিক, মো. সাইদুর রহমান, মো. রহমত আলী, মো. আব্দুল হামিদ খান, মো. আব্দুল ছিদ্দিক, মো. আব্দুল খালেক, যোগেন্দু দাস, শ্রীকান্ত বাবু, হরলাল দাস, অধর দাস, অরবিন্দু রায় এবং কোবিন্দ্র নাথ স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে ঢেলে দিয়েছিলেন বুকের তাজা রক্ত।

জানা যায়, মধু মিয়ার অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ থাকায় সামনা-সামনি মোকাবিলা করেছেন হানাদার বাহিনীকে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাটে পরিবার রেখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ রক্ষায়। যুদ্ধ শেষে পরিবার ফিরিয়ে আনেন ভারতের বালাট থেকে। পরবর্তীতে মধু মিয়া নিজেই দেখাশোনা করতেন এই সমাধিস্থল। যেখানেই খবর পেয়েছেন কেউ শহীদ হয়েছেন, সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু জানান, ১৯৭৯ সালে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট শহীদদের সমাধিগুলো সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়। ৮২ ফুট লম্বা, ৮১ ফুট প্রস্থ ও পাঁচ ফুট উচ্চতার এক দেয়াল তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর সেনানী সাব সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) এএস হেলালউদ্দিন সব শহীদদের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে দেন।

মধু মিয়া।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া শহীদ বীর সেনানীদের সমাধির পাশে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন স্মৃতিসৌধ দেখতে ও শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে।

মুক্তিযোদ্ধা গবেষক মফিদুল হক বলেন, সুনামগঞ্জের ডলুরায় সমাধিস্থলে আমি গিয়েছি। অবাক হয়েছি ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্ট সমাধিগুলো সংরক্ষণ করেছে। তা সত্যি অন্যদেরও অনুসরণ করার মতো। এরকম ঘটনা বিরল। এই ধরনের আরেকটি আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কুল্লাপাথরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীনে বালাট সাব সেক্টরের আওতায় ছিল এই ডলুরা এলাকা। ডলুরার পার্শ্ববর্তী সীমান্তের ‌ওপারের মৈলাম এলাকায় কয়েক লাখ বাঙালি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। এপারের জয়বাংলা বাজার ছিল মুক্ত এলাকা। পাকিস্তানি হানাদাররা এখানে আসতে পারত না। জয়বাংলা বাজারের কয়েক কিলোমিটার দূরে সুরমা নদী, দক্ষিণ পাড়ে সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘরে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। আর বালাটের একটি পাহাড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকায় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে শহীদ ৪৮ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয় এই ডলুরায়। পরে ওই ৪৮ বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিতকারী সদর উপজেলার ডলুরা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মধু মিয়াকেও এখানে দাফন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদদের কবর দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন মধু মিয়া। আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জানাজা পড়াতেন মুন্সি তারু মিয়া। এ ছাড়া আফছার উদ্দিন, কিতাব আলী, আ. রহিম, মোগল মিয়া, হযরত আলী ও মফিজ উদ্দিন— তারা সবাই মধু মিয়াকে সহযোগিতা করতেন। হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের দাহ করার কাজ করতেন নেপু ঠাকুর। এরা সবাই ছিলেন প্রবাসী সরকারের নয় সদস্য বিশিষ্ট অনুমোদিত কমিটির সদস্য। ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ মধু মিয়ার মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ডলুরা শহীদ স্মৃতিসৌধের ভেতরেই তাকে দাফন করা হয়। ৪৯ জন শহীদের সঙ্গে তিনিও সেখানে চিরনিদ্রায়।

বাংলাদেশ সরকারের এ অঞ্চলের প্রতিনিধি জাতীয় পরিষদ সদস্য দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরী ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে মধু মিয়ার কাজের স্বীকৃতি দেন।

এক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান জজ মিয়া সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এখনো একা থাকলে গুলি আর বোমার শব্দ শুনি। সুনামগঞ্জে মার্চের পর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদারদের হামলার পর অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আসতে থাকে। কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে চলে যায় রিফিউজি ক্যাম্পে। আবার কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ডলুরা সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় এবং মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় রোজই অনেক মানুষ এ পথে আসত। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল, এসব মানুষদের যেন আমরা ঠিক মতো সেবা দিই, আশ্রয় দিই। প্রায় প্রতি রাতেই আমরা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দু-চারজন লোকের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করতাম। বিশেষ করে তখন সিলেটের এম সি কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ, ভৈরব কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা এ পথে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য আসত মুক্তিযোদ্ধা হতে, যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। তাই কৌশলগত কারণে এ জায়গাটা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য তারা সুরমা নদীর এ পাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে ভারতগামী লোকদের আসা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তবুও তারা বিভিন্ন ঘুরপথে ঝুঁকি নিয়ে আসতে থাকে। এরপর শুরু হয় ডলুরা ও তার আশপাশে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ, কাউন্টার-অ্যাটাকে ওরাও যেমন মরতে থাকে, তেমনি আমাদেরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। তাদের শবদেহগুলো গ্রামবাসী ও সহযোদ্ধারা এই ডলুরা সীমান্তে এনে সমাহিত করেন।’ (২৯ জুন ২০১০, প্রথম আলো)

মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের নিয়োগকৃত স্থানীয় খোকা মিয়া মাসিক মাত্র পাঁচ শ টাকা সম্মানীর বিনিময়ে ২০০১ সাল থেকে সমাধিস্থলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন।

প্রতি বছর সুনামগঞ্জ জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে বিজয় দিবসের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর সকালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া-মিলাদ মাহফিল, পবিত্র গীতা পাঠ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক ও মুক্তিযোদ্ধারা পৃথকভাবে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের দাবি, এই জায়গাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর দিলে জাতীয় ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে এবং দেশপ্রেমের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

Comments