ওয়াপদা টর্চার সেল: দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান স্বজনেরা
'১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বরিশাল নগরীর ওয়াপদা আর্মি ক্যাম্পে আমাদের নিয়ে আসা হয়। এর আগে গৌরনদী ক্যাম্পে ভীষণ টর্চার করা হয়। আমার পায়ের পাতা চিড়ে দেওয়া হয়েছিল। কী কারণে বরিশালের ওয়াপদায় আনা হয়েছিল তা জানি না। আমার সাথে আমার বন্ধু আনোয়ারকেও নিয়ে আসা হয়,' বলছিলেন সেসময় ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থী এমএজি কবীর ভুলু।
কীর্তনখোলা নদীর তীরে ওয়াপদা গণহত্যার কথা বলছিলেন। বলেন, 'আনোয়ার বলশালী চেহারার ছিল। একদিন ভোররাতে আনোয়ারকে তুলে নিলো। আনোয়ার হাঁটতে পারছিল না। তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। তারপর গুলির শব্দ। এরপর আর কোনদিন আনোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তৎকালীন ছাত্রনেতা ফিরোজ কবিরকেও এভাবে গুলি করে মারা হয়।’
তিনি জানান, প্রতিদিনই দিনের বেলা ট্রাকে করে বরিশালের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ওয়াপদা টর্চারসেলে। ভোররাতে তাদের খালের পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হতো।
মুক্তিযোদ্ধা ও সে সময়কার স্থানীয়রা জানান, ওয়াপদা পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্তত ২৫-৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হতো।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ থেকে সাত হাজার বাঙ্গালিকে হত্যা করা হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে তাদের মাত্র কয়েকজনের নাম জানা যায়। তাদের মধ্যে আছেন- বরিশালের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম, আইনজীবী সুধীর চক্রবর্তী, সংস্কৃতিকর্মী মজিবর রহমান কাঞ্চন, আবুল হোসেন, ফিরোজ কবির, শাহাবুদ্দিন তপন, নজরুল ইসলাম, আলমগীর, মঞ্জু, বংশী চক্রবর্তী, মোবারক আলী, জে এন চক্রবর্তী, গোড়াচাদ শীল, শুক্কুর বেপারী, আ. গফুর, মোবারক শিকদার, দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন।
সংস্কৃতিকর্মী শহীদ মজিবর রহমান কাঞ্চনের ছেলে শফিউর রহমান জামাল বলেন, ‘বাবা একজন মঞ্চাভিনেতা ছিলেন। ষাটের দশক থেকে যাত্রা থিয়েটার করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে ডাকতেন “ধলা কাঞ্চন”।’
'১৯৭১ সালে আমাদের কালীশচন্দ্র রোডের বাসায় পাকিস্তান আর্মি বাবার খোঁজে আসে। বাবাকে না পেয়ে আমাদের দুই ভাইকে ধরে ওয়াপদা আর্মি ক্যাম্পের টর্চার সেলে নিয়ে যায়। ঘোষণা করে, কাঞ্চন মিয়া সারেন্ডার করলে তার দুই সন্তানকে ছেড়ে দেয়া হবে। ঈদের দিন বাবা ওয়াপদায় আত্মসমর্পণ করলে আমাদের দুই ভাইকে ছেড়ে দেয়। আর, বাবাকে নির্মম অত্যাচার করে মেরে ফেলে।'
বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের ভাই হারুণ অর রশিদ মারা যাওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাকেও ওয়াপদা টর্চারসেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওয়াপদার নারকেল গাছে উল্টো করে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। পরে গাছ থেকে নামিয়ে রক্তের উপর রেখে দেওয়া হতো আহত দেহ।
পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন মালতি রানী। তিনি জানিয়েছিলেন, সেখানে রাতে নারীদের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে আসতো।
মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার মাহফুজ আলম বেগ জানান, ওয়াপদা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি যখন যায়, সেখান থেকে তারা অনেক নারীকে উদ্ধার করেন।
বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ দুলাল জানান, এখানে ক্যাম্পে মাংস সরবরাহ করতেন বটতলার হালিম। তিনি বলেছিলেন, সেখানে আবদুল গফুর নামে একজনকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা নির্যাতন চালায়। হালিম তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে, গফুরের আহত চোখ কোটর থেকে পড়ে যেতে দেখেন। গফুর হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে হালিমের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
বরিশাল নগরীর বাজার রোড এলাকা থেকে ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা তুলে নেয় চিত্রকর জগন্নাথ দে কে। টর্চার সেলে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন তিনি। বলেন, ‘আমি ছবি আঁকতাম। ৭১ সালেও শহর ছেড়ে যাইনি। ১২ আগস্ট পাকিস্তানি আর্মি আমাকে তুলে নেয়। স্থান হয় ওয়াপদা ক্যাম্পে। অন্যদের মতো আমিও মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। এক বালুচ সেনা সেখানে আমাকে চিনতে পারে। পাকিস্তানি মেজর আমাকে ডেকে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান দিবস নিয়ে ছবি আঁকতে বলে।’
ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরলেও এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় টর্চার সেলের সেসব দুঃসহ স্মৃতি। যারা ফিরলো না, যারা ফিরবে না আর কোনো দিন তাদের স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হবে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বরিশালে প্রথম প্রবেশ করে এবং ওয়াপদা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে। সেই সময় থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন তারা এখানে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তান আর্মি কারফিউ দিয়ে লঞ্চে করে বরিশাল ত্যাগ করলে ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা নগরীতে প্রবেশ করতে শুরু করে।
ওয়াপদা এলাকাকে ঘিরে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) এর উদ্যোগে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আবদুল্লাহ।
Comments